আমার কি শাস্ত্র পাঠ করা উচিত?
একজন আধ্যাত্মিক সাধকের ক্ষেত্রে শাস্ত্র কি ভূমিকা পালন করে? সদগুরু জ্ঞান এবং জানার মধ্যে পার্থক্যটি তুলে ধরছেন এবং বিষয়টি ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের কৃষ্ণ ও অর্জুন সম্পর্কে একটি গল্প বলছেন।
একজন আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে শাস্ত্রের ভূমিকা কী?
সদগুরু: 'জ্ঞান' বলে কিছু হয় যা সঞ্চিত স্মৃতির স্তূপ, আবার 'জানা' বলে কিছু হয় যা জীবনের নিখাদ উপলব্ধি। জ্ঞান কেবলমাত্র জীবনের সম্পর্কে আপনার সিদ্ধান্ত। আপনি যদি সঞ্চিত জ্ঞান থেকে জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসেন, এটি সংস্কার-আচ্ছন্ন জ্ঞান হয়ে যায়। এটি আপনাকে কোনকিছু নতুনভাবে উপলব্ধি করতে দেবে না। আপনার সাথে কখনই নতুন কিছু ঘটবে না। জ্ঞান আপনার বেঁচে থাকা প্রক্রিয়াটির জন্য উপযোগী তবে এটি আপনাকে কখনই মুক্ত করে না।
আপনি কি আপনার অস্তিত্ব রক্ষার যত্ন নেবেন না? অবশ্যই নিতে হবে, কিন্তু যখন একটা ছোট্ট কীট(পোকা) আপনার মস্তিষ্কের অতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশের সমান মস্তিষ্ক নিয়ে এই গ্রহে যথেষ্ট ভালভাবে বেঁচে থাকতে পারে, আপনার পুরো জীবনটা কি কেবল বেঁচে থাকার জন্যই ব্যয় করা উচিত - যখন আপনার কাছে এত বড়ো একখানা মস্তিষ্ক রয়েছে? যোগ পদ্ধতিতে আমরা মনকে ষোলোটা ভাগের মাধ্যমে দেখি। বলা হয় যে এই ষোলটি ভাগের মধ্যে মাত্র একভাগই বস্তুজগতে অসামান্য সাফল্যের জন্য যথেষ্ট। বাকি পনেরো ভাগ আপনার অভ্যন্তরীণ কল্যাণের প্রতি কেন্দ্রিত করা উচিত কারণ সেটা বস্তুজগতের চেয়ে অনেক বড় সুবিশাল একটি স্থান। এমনকি আজকের দিনে বৈজ্ঞানিকরাও বলেন যে মহাবিশ্বের মাত্র চার শতাংশ সৃষ্টি এবং বাকিটা 'ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি'(অজ্ঞাত পদার্থ ও অজ্ঞাত শক্তি)। কাজেই আপনার মস্তিষ্কের চার শতাংশই যথেষ্ট, তবে প্রাচীন যোগীরা একটু বেশি উদার ছিলেন। তারা আপনাকে ছয় শতাংশেরও কিছু বেশি দিয়েছেন- অত্যন্ত সফলভাবে আপনার বৈষয়িক জীবন পরিচালনার জন্য!
সুতরাং শাস্ত্রের প্রতি যথাযথ সম্মান জানিয়েও, এটি সঞ্চিত জ্ঞান। যদি এটি ইঞ্জিনিয়ারিং বা সাহিত্য বা ইতিহাসের বই হত, আমি এটি পড়তে বলতাম। যদি এটি নিজেকে জানার বই হয়- যদি আপনি এখানে আছেন এবং জীবিত রয়েছেন, অন্য কোনও বই পড়ার চেয়ে এই বইটি - অর্থাৎ আপনার নিজেকে পড়া ভাল। আপনি সৃষ্টিকর্তার নিজের রচিত একটি গ্রন্থ। এই জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলে এই বইটি পড়াই সবচেয়ে ভাল। অন্য যে কোনও বইয়ের ক্ষেত্রে, যদি সেটা ঈশ্বরের নিজের কথাও হয়, যদি এটা কোনো ভাষায় লেখা হয়ে থাকে- তবে স্পষ্টতই এটা মানুষের দ্বারা লেখা হয়েছিল। মানুষের মন অনেক বেশি বিকৃতি করে থাকে। আজ যদি আপনি স্বচক্ষে কিছু দেখে আপনার প্রতিবেশীকে বলেন, সে গিয়ে অন্য একজনকে বলবে। এটি যদি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পঁচিশজনের কাছ থেকে ঘুরে আপনার কাছে ফিরে আসে, আপনি কি সেই গল্পটি আর চিনতে পারবেন? এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে মানুষ প্রচুর বিকৃতি করতে সক্ষম। যখন কোনকিছু কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসছে, আপনি কল্পনা করতে পারেন যে এর সাথে কতকিছু ঘটে থাকতে পারে।
আপনি যদি নিজেকে জানতে চান, অন্য কারও লেখা বই পড়বেন না। আপনি যদি নিজের সম্পর্কে কোনো বইতে পড়েন, তাহলে আপনি আসল নন - আপনি কেবল একটা গল্প মাত্র। আপনার নিজের অভ্যন্তরে দেখার প্রয়োজন। নজর ঘুরিয়ে এদিকে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য আপনার কাছে অবশ্যই প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকতে হবে। যাকিছু লেখা হয়েছে আমি সেসব ফালতু বলছি না - কিন্তু আপনি যদি নিজের স্বরূপ গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শেখেন তবে আপনি দেখবেন সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলোই বাসি।
যখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে গীতা প্রদান করছিলেন, প্রত্যেকবার যখনই কৃষ্ণ কিছু বলছিলেন - অর্জুন, যিনি সেই যুগের একজন রাজপুত্র হওয়ার সুবাদে সেরা শিক্ষা লাভ করেছিলেন - বলতেন, " কিন্তু না। শাস্ত্র অন্য কথা বলে"। তিনি তাঁর পড়া সমস্ত বইয়ের কথা উল্লেখ করছিলেন। কৃষ্ণ হেসে বললেন, "যখন মানুষের মধ্যে আলোর প্রকাশ ঘটে, তখন আপনার সমস্ত ধর্মগ্রন্থ বন্যার সময় জল ভরা ট্যাঙ্কের মতো”।
যদি আপনি মরুভূমিতে থাকেন, এক ট্যাঙ্ক ভর্তি জল আপনার কাছে সমুদ্রের মত মনে হবে। যখন বন্যা এসেছে, এক ট্যাঙ্ক ভর্তি জলের কি অর্থ আছে? প্রতিটি মুহূর্তে যখন সৃষ্টিকর্তা আপনার অন্তরে কম্পিত হচ্ছে, আপনাকে অবশ্যই নিজের অভ্যন্তরে দেখতে হবে।