সত্যের অনুসন্ধানে খোলস ফাটানো
সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার পদ্ধতির সঙ্গে ডিমের খোলস ফাটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি হতে দেওয়ার তুলনা করেছেন সদগুরু। সদগুরু ব্যাখ্যা দিয়েছেন যতক্ষণ না নিজের মধ্যে স্বর্গ ও নরককে ধ্বংস করে ফেলা যায়, সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। তিনি তুলনা করেছেন সেই পদ্ধতির সঙ্গে ডিম ফাটানোর - যখন এটি ফেটে যায়, তোমাকে বাইরে যেতে হয় না সম্পূর্ণ নতুন কিছু বেরিয়ে আসে।
সদগুরু ব্যাখ্যা দিয়েছেন যতক্ষণ না নিজের মধ্যে স্বর্গ ও নরককে ধ্বংস করে ফেলা যায়, সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। তিনি তুলনা করেছেন সেই পদ্ধতির সঙ্গে ডিম ফাটানোর - যখন এটি ফেটে যায়, তোমাকে বাইরে যেতে হয় না সম্পূর্ণ নতুন কিছু বেরিয়ে আসে।
সদগুরু: এই জগতের সর্বত্র, মানুষের সমাজকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে স্বর্গ ও নরকের প্রচার করা হয়েছে। যখন তারা জানত না কিভাবে একজন ব্যক্তিকে অথবা একদল ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তারা একটা ধারণা নিয়ে এলো, “যদি আমি এখন আপনাকে শাস্তি না দিতে পারি, তাহলে ওখানে গিয়ে আপনাকে অবশ্যই শাস্তি দেব। সমস্ত রকমের ধার্মিকতা দেখানোর জন্য যদি আমরা আপনাকে এখানে পুরস্কৃত না করতে পারি, তবে পুরস্কারও দেওয়া হবে ওখানেই।”
কিন্তু সত্য যদি অস্তিত্বের বাস্তবতা ছাড়া অন্য কিছু হয়, তাহলে সেখানে যাওয়ার কোনো মানেই থাকে না। যখন আমরা মন্ত্র উচ্চারণ করি ‘অসতোমা সদ্গময়া’, এটার মানেই হচ্ছে অসত্য থেকে সত্যের দিকে চলা। ‘চলা’ শব্দটিতে একটা দূরত্ব অতিক্রম করার আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু এটা কোন যাত্রা নয়। জানাটা দুরের ব্যাপার নয়, জানার বস্তুটি কোন পর্বতশৃঙ্গে বসে নেই, রয়েছে আপনার অন্তরে।
আপনার ভেতরের স্বর্গ ও নরক
প্রথম জিনিস যেটাকে যোগ কুঠারাঘাত করছে সেটা হচ্ছে স্বর্গ এবং নরক। অন্তরের কল্যান করার প্রযুক্তি এবং একজনের মুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার পদ্ধতি অর্থহীন হয়ে পড়ে কারণ স্বর্গ-নরকের উপস্থিতি মানে আপনার যাওয়ার দুটোই জায়গা রয়েছে – একটি ভালো জায়গা আর একটি মন্দ জায়গা। যদি আপনি কোন ভাবে ভালো জায়গায় যাওয়ার টিকিট পেয়ে যান তাহলে আপনি কেমন ভাবে নিজের জীবন কাটাবেন তার জন্য কোন চিন্তাই করতে হবে না। মানবতা এইরকমই স্থুলভাবে বেঁচে ছিল। কারণ এতে ধর্মের সাহায্য ছিল। এটা কোন প্রাধান্যই রাখে না আপনি কি করছেন, কেবল এটা, এটা এটা বিশ্বাস করলেই আপনার ভালো জায়গার টিকিটটা নিশ্চিত।
যদি আপনি আপনার ভেতরের স্বর্গ ও নরককে এখনই ধ্বংস না করতে পারেন, তাহলে সত্যের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। আপনার শরীরে এবং মন এখন নয় স্বর্গ না হয় নরক সৃষ্টি করে চলেছে; তারা উভয়কেই তৈরি করতে সক্ষম। আপনার বর্তমান অবস্থান নির্বিশেষে তারা আপনার মধ্যে স্বর্গ বা নরক সৃষ্টি করেই চলেছে।
আপনার বৈষম্য সৃষ্টিকারি মন এমন যে, যখন আপনি নরক তৈরি করেন এবং সেটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে, আপনি তখন সামান্য প্রত্যাবর্তন করেন। যখন আপনি স্বর্গ তৈরি করেন এবং বেশ ভাল লাগতে থাকে, আপনি তখন বাস্তবের সাথে যোগাযোগ হারাতে শুরু করেন, তারপর বাস্তব যখন আপনাকে আঘাত করে তখন আবার আপনি সামান্য প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু যখন আপনি শরীরকে হারান, তখন আপনি বৈষম্য করার ক্ষমতা হারান। তারপর, একটি মন যেটি স্বর্গ সৃষ্টি করার পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে সেটি স্বর্গ তৈরি করতে থাকবে, লক্ষ গুণ সুখী হবে। একটি মন যা নরক সৃষ্টি করতে ব্যস্ত হয়, সে লক্ষ লক্ষ গুণে নরক সৃষ্টি করবে কারণ বৈষম্যকারী ক্ষমতা - যখন আপনি অনুভব করেন অনেক হয়েছে তখন ফিরে যাওয়ার ক্ষমতা - আর থাকে না।
স্বর্গ বা নরক গড়ে তোলার উপাদানগুলো ঠিক আপনার চারপাশেই রয়েছে, আপনার শক্তিগুলো যেভাবে সঞ্চালিত হচ্ছে তার মধ্যেই। আপনি যদি নিজের বিচক্ষণতা অনুযায়ী চলেন, তাহলে আপনার সিদ্ধান্ত হবে, “আমি নরকটাকে ধ্বংস করে দিই এবং স্বর্গটাকে ধরে রাখি”। কিন্তু এটা কখনোই হবে না কারণ স্বর্গ-নরক গঠনের উপাদানগুলো একই; সেই কক্ষগুলোও একই। কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে, সেগুলি পরমানন্দের কক্ষ, কিছু লোকের জন্য নির্যাতনের কক্ষ, এবং যেকোনো মুহূর্তেই একটা অন্যটায় পরিণত হয়ে যেতে পারে। এটা আলো জ্বালানোর সুইচ-এর মতো। যদি আপনার কাছে দু'রকমের আলো থাকে, একটি সাদা আলো, একটি নীল আলো, আর যদি আপনি নীল আলোটা জ্বালান আপনার অনুভূতি এক রকম হবে। যদি আপনি সাদা আলোটা জ্বালান তাহলে হঠাৎই আপনার অনুভব হবে জায়গাটি সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। কিন্তু অন্ধকার থাকলে, একটা আলো জ্বালাতে গিয়ে অন্যটা জ্বালিয়ে দিতেই পারেন। এইরকমই ঘটবে।
আলোকের অনুপস্থিতি!
নরককে ধ্বংস করে কেবল স্বর্গকে ধরে রাখা সম্ভব না। কিন্তু আপনি সর্বদা আনন্দে থাকতে পারেন, নরকের সম্ভাবনা উধাও হয়ে গেছে বলে নয়, আপনার বৈষম্যমূলক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয়ে উঠেছে বলে। নরক যাতে তার ডানা না মেলতে পারে সেদিকে আপনি নজর রাখলেন। তবে সতর্কতার এই ক্ষমতা শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্তই কার্যকারী। কিন্তু যদি আপনি সমস্ত উপাদানগুলোকে সরিয়ে নিয়ে যান, যা দিয়ে আপনি এটা বা ওটা তৈরি করতে পারেন, তাহলে আপনি রয়ে যাবেন অন্ধকার হলের মধ্যে যেখানে সাদা আলো বা নীল আলোর কোনোটাই নেই। কিন্তু আপনি এমন এক দিশা ধরেছেন যেখানে আলোর কোনো অর্থই হয় না। আলো শুধুমাত্র তার জন্যই গুরুত্ব রাখে যে তার চোখ খুলে কোথাও যেতে চায়। আলো তার কাছে কোনো গুরুত্বই রাখে না যার চোখ বন্ধ এবং যে অন্য জগতে থাকে। তার জন্য আলো একটি উপদ্রব।
খোলসটাকে ফাটানো
তো, অসত্য থেকে সত্য দিকে অগ্রসর হওয়ার পদ্ধতিটা বাস্তবে একটা ভৌগলিক দূরত্ব অতিক্রম করার ব্যাপারে নয়। এটি একটি ডিমের খোসার মতো - এখন আপনি খোলসের বাইরে আছেন। আপনি অন্তরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপনি ডিমটাকে ফাটাতে শুরু করবেন। আপনি ভাবছেন কখন ভাঙবে আর ভিতরে যাবেন, কিন্তু যেই না ডিম ফাটল বেরিয়ে এল একটি মুরগী। এটাই হচ্ছে আসল ব্যাপারটা। আপনি এখানে বসে রয়েছেন আর অপেক্ষা করছেন অন্তরে যাওয়ার। যখন এটি ভাঙবে কেউ ভেতরে যাবে না, কিন্তু একটা সম্পূর্ণ নতুন সম্ভাবনা বেরিয়ে আসবে। এ কারণে যোগব্যায়ামের প্রতীক হল সহস্রার, হাজার-পুষ্পদলের একটি ফুল, বেরিয়ে আসছে। যখন আপনি খোলসটিকে ফাটালেন, তখন আপনি যা কল্পনা করেননি এমন কিছু একটা বেরিয়ে এল।
আপনি যদি এই খোলসটাকে ভাঙতে চান, আপনি নিজে এটা কখনই করতে পারবেন না কারণ এটা আপনি নিজেই। কিভাবে আপনি নিজেকে ভাঙতে পারবেন? এটা করার জন্য মনের জোর আপনার নেই। এই মনটা হয়তো বলবে, “হ্যাঁ, চলো এটাকে ভাঙ্গা যাক, একটি মুরগী বেরিয়ে আসবে”। না, আপনার কখনই সেই সাহস হবে না।
সেই জন্য আপনার চাই বাইরে থেকে একটা হাতুড়ির আঘাত, যেটাকে সাধারণত কৃপা বলা হয়। আপনি নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করবেন যে সেটা আপনার উপরে আসবেই। এটা হচ্ছে অনেকটা শিশুদের দাঁত নড়ে যাওয়ার মত, আর সে বলে “হাত দিও না, হাত দিও না!” অভিভাবক বলেন, “কই দেখি, দেখি”। এবং তারপর টুক করে সেই দাঁতটা বেরিয়ে আসে, এবং শিশুটি খুব আনন্দ পায়। আপনার কি সেই অনুভবটা মনে আছে যখন আপনার প্রথম শিশু-দাঁত পড়েছিল? সেখান থেকে ব্যথাটা চলে গেছে এবং একটা শূন্যতার অনুভব হচ্ছে। এটা নিয়ে আপনি কিছুদিন খেলেছেন, কিন্তু আপনি নিজের দ্বারা এটা কখনোই বের করতে পারতেন না। তো আমরা সেই মুহূর্তটারই অপেক্ষা করছি। সাধনা হল শুধুমাত্র এটাই - আপনার মুখ খোলানো। এটা সহজ কাজ নয়, আপনি তো জানেনই!