অর্থনীতির প্রসার ও অন্তরের কল্যাণ হোক একইসাথে
সদগুরু দেখছেন যে, ভারত যেভাবে অর্থনৈতিক উত্থানের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, এহেন অবস্থায় মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া না নিয়ে আসলে, তা এক বিপর্যয় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সদগুরু: সমাজ এখন ক্রান্তিকালীন অবস্থায়, এক স্তরের অর্থনীতি থেকে অন্য স্তরের অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। আগামী কয়েক বছরে এটা নাটকীয়ভাবে ঘটতে চলেছে। আমরা আশা করছি এটা গ্রামীণ এলাকাগুলোতে প্রবেশ করতে চলেছে, আর এটা করবেও। কথা হল শুধু যে আমরা যদি এটা সহজ করে দিই, এটা খুব ভালোভাবে হবে। আমরা যদি সহজ করে না তুলি, এটা বলপূর্বক ও যন্ত্রণাদায়কভাবে ঘটবে, কিন্তু যেভাবেই হোক এটা হবে।
আমরা দেখছি স্টক মার্কেট কীভাবে নতুন নতুন শীর্ষ ছুঁচ্ছে। এগুলো কেবল সংখ্যা নয়, আমরা কোন দিকে যাচ্ছি - এটা তারই সূচক। বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা ও বিনিয়োগ পদ্ধতিগুলো ভারতকে সবসময় পাশ কাটিয়ে যেত কারণ ওরা ভয় পেত আমাদের - আমাদের দুর্নীতিকে, আমাদের অক্ষমতাকে, আমাদের তালগোল পাকিয়ে ফেলার ব্যাপারটাকে আর যা শুরু করি তার কোনোকিছুই শেষ না করার অভ্যেসটাকে। সেই ছবিটা নাটকীয়ভাবে পাল্টে যাচ্ছে আর অর্থ বাজারগুলো এখন ভারতের দিকে আসতে থাকছে, দেখবেন সবকিছু খুব তড়িঘড়ি পাল্টে যাবে। এটা হতে বাধ্য।
আর্থিক পরিস্থিতি যখন পাল্টায়, সমাজের মধ্যে খুব নাটকীয় সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্যও আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আর্থিক স্বাধীনতার সাথে সাথে, নির্দিষ্ট একটা সংস্কৃতির মৌলিক বিষয়গুলি সবসময় পাল্টে যায়। প্রতিটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি যখন নিজের ইচ্ছেমতো যা কিছু করার সুযোগ পান, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে প্রয়োজনীয় সচেতনতার দ্বারা আমরা সেই ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতায়ন ঘটাই যাতে তিনি সঠিক পথটি বেছে নিতে পারেন। বেশিরভাগ সমাজের ক্ষেত্রেই, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে নানা সমস্যার উৎপীড়ন এসে হাজির হয়েছিল কারণ স্বতন্ত্র ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ঠিক পথটিকে বেছে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব ছিল।
অর্থনৈতিক উন্নতি মনুষ্যজাতির কল্যাণ নিয়ে আসার বদলে, সাধারণত দেখা যায় ঐ জাতি বা সমাজের একটি প্রজন্ম সঠিক নির্বাচন করতে না পেরে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। উদাহরণ স্বরূপ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে গ্রহের সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী দেশ। ১৯৩০-এর দশকে তাঁরা খুব কঠিনরকম মন্দা অবস্থার মধ্য দিয়ে যান যখন এমনকি নাগরিকদের জন্য খাবারও অবধি একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যেটা ছিল মারাত্মক এক বিপর্যয় - কেড়ে নিলো লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। যুদ্ধের পরের প্রজন্মটি সত্যিই খুব খেটেখুটে দেশটিকে আবার ঠিক লাইনে নিয়ে আসে। ১৯৬০-এর দশকে, অর্থনৈতিক উত্থান ঘটছিল কিন্তু মনুষ্যজাতির ঐ প্রজন্মটি ভুলভাল সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আর প্রায় ১৫-২০ বছর যাবৎ মাদক, অ্যালকোহলের ভোগের পরিমাণ সমাজটিকে পথভ্রষ্ট করে আছড়ে ফেলে ও সমগ্র জাতিটিকেই প্রায় লাইনচ্যুত করে ফেলে। তারপর আবার ১৯৭০ থেকে ১৯৮০-এর দশকে তাঁরা সামলে ওঠেন।
সঠিক পথটি বেছে নেওয়া
আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া এটা নিশ্চিত করার একটা উপায় যে সঠিক পথটি বেছে নেওয়ার জন্য লোকজনের প্রয়োজনীয় সচেতনতা আছে। যখন সমৃদ্ধি ঘটবে, তাঁরা নিজেদের মাথাটা খুইয়ে বসবেন না। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দারিদ্র্য খুব ভয়ানক একটা সমস্যা। কিন্তু যেই মুহূর্তে তাঁরা এটা কাটিয়ে ওঠেন, অনেক মানুষেরই তাঁদের মাথাটা খারাপ করে ফেলে অন্য আরেকটা সমস্যায় পড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। আমরা এটা দেখতে চাই যে, জাতির যেই অর্থনৈতিক উত্থানটি ঘটছে, লোকজন সেটা উপভোগ করছেন কারণ এটা বঞ্চিত এক জনসংখ্যা, সবকিছু থেকেই বঞ্চিত।
তো এই সচেতনতার প্রসার ঘটানো এবং লোকজনকে সঠিক পথ বেছে নিতে সক্ষম করে তোলার ক্ষমতায়ন ঘটানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক উত্থান যেহেতু ঘটছে তাই এই প্রক্রিয়াটি আমাদের সত্যিই খুব দ্রুত করতে হবে। আমরা আগামী কয়েক বছরে ৯ থেকে ১০% বিকাশের কথা বলছি, যেটা বিস্ময়কর। একটা সময় যাবৎ ৯ থেকে ১০% বিকাশকে ক্রমাগত ধরে রাখা কোনো মুখের কথা নয়। কিন্তু একই সময়ে আমাদের এই মৌলিক প্রশ্নটিও করা আবশ্যক: কতটার ১০%? ১২৫ কোটি লোকের জন্য, আমাদের অর্থনীতির পরিমাণ দুর্ভাগ্যবশত খুব কম। এখন বেড়ে উঠছে কিন্তু তাও এটা অত্যন্ত সামান্য।
পাশ্চাত্যের অর্থনীতি বিশ্লেষকগণ বুঝতে পারেন না যে এরকম অর্থনীতি দিয়ে মানুষ এমনকি খেতেই বা পাচ্ছে কীকরে। ওনারা বুঝতে পারেন না যে কীভাবে একজন মানুষ সারাদিনে এক ডলার উপার্জন করে খান... আমরা আমাদের কৃষকদের আত্মহত্যা করতে দিচ্ছি, এটাই একমাত্র কারণ আমাদের খেতে পাওয়ার। বাকি সবকিছুর দাম বাঁধা, কিন্তু কোনোভাবে আমরা সবসময় বিশ্বাস করি যে খাবারদাবার বিনামূল্যে পাওয়া যাওয়া উচিত। এটা ঠিক ছিল যখন আমাদের প্রায় ৯৫% ছিলেন কৃষক। এখন,৬০% চাষ করছেন আর বাকি ৪০%কে খাওয়াতে অনাহারে থাকছেন ৬০%। সেটা একেবারেই ভালো নয়।অর্থনৈতিকভাবে এর মানে হল যে,১০০ জনকে খাওয়াতে ৬০ জন রান্না করছেন। এটা এমনকি লোকবলেরও ভালো বন্টন নয়। ১০০ জন লোকের জন্য যদি ৬ থেকে ৮ জন লোকও রান্না করতেন, ঠিক ছিল। যদি ১০জন রান্না করছেন - ঠিক আছে - খারাপ রাঁধুনি বা রকমারি রান্না, যে কোনো একটা। ৬০ জন রাঁধছেন মানে সেটা ক্কঅর্থনীতি চালানোর ভালো উপায় নয়। কিন্তু এটাই সাবসিস্টেন্স ফার্মিং তথা কৃষকের নিজের প্রয়োজনার্থে চাষ থেকে অর্থকরী ফসল চাষের দিকে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়া।
এখন আমরা যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সেটা একটা যন্ত্রণাকর প্রক্রিয়া আর যন্ত্রণার আসল ধাক্কাটা সবচেয়ে দরিদ্র ও দুর্বল মানুষরাই সামলে থাকে। এটা বিভিন্ন উপায়ে লঘু করা প্রয়োজন, যেটা একটা জাতি হিসেবে আমাদের করা এখনও বাকি, কিন্তু একটা মৌলিক জিনিস যেটা ঘটা প্রয়োজন তা হল, লোকজনের আরেকটু স্পষ্টভাবে, আরেকটু বেশি মনোযোগ সহকারে ভাবা শুরু করা দরকার।এটা সবচেয়ে জরুরি যে তাঁদের চিন্তাধারা যাতে তাঁদের জাতি, সম্প্রদায় বা ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত না হয়। তাঁদের সোজাসুজি ভাবা উচিত। এটা সার্থক করে তুলতে আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া একটি শক্তিশালী সরঞ্জাম হয়ে ওঠে।
ভারতকে বাসভবন করে তোলা, কারাগার নয়
এমন একটা সময় ছিল, প্রায় ৫০০ বছর আগে, তখন সবাই ভারতে আসতে চাইতো। ভাস্কো ডা গামা, কলম্বাস - যদিও উনি একটা ভুল করেছিলেন, তবে তাঁরা সবাই ভারতে আসতে চাইতেন। বিশাল ঝুঁকি নিয়ে, হাজার হাজার জাহাজ পাড়ি দিয়েছিল। যেনতেন প্রকারে তাঁরা ভারতে আসতে চাইতেন কারণ এটা ছিল গ্রহের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনীতি। গত ২৫০ বছরে, আমরা নিচে নেমে যাই, সত্যিকারের তলানিতে। আমি সকালের খবরের কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে দেখি যে বিশ্ব ফুটবল র্যাঙ্কিংয়ে ভারতকে ওই ১৫০ তম দেশ বলে গণ্য করা হয়েছে। বাহ্! ফুটবল দল সবকিছুর মীমাংসা করে দেয় না কিন্তু এই ধরণের জিনিসগুলো ব্যারোমিটারের মত মেপে দেখিয়ে দেয় যে মানুষজন ঠিক কেমন। এটা ইঙ্গিত করে মানুষজন কত স্বাস্থ্যকর, সুসংহত ও লক্ষ্যে স্থির।
৫০০ বছর আগে, সবাই এখানে আসতে চাইতো।এখন, সবাই ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। এখন দেশকে আবারও এমনভাবে গড়ে তোলার সময় এসেছে যাতে সবাই এখানে আসতে চায়। এটা হওয়া শুরু করেছে কিন্তু একেবারেই যথেষ্ট পরিমাণে নয়। স্টক মার্কেট নির্দিষ্ট কোনো স্তর ছুঁলেই যে এটা হয়ে যাবে এমন নয়। আমরা নিজেদের কীভাবে পরিচালনা করি সেটাই ঠিক করে দেবে যে কেউ এ দেশে আসতে আসতে চাইবে না ছেড়ে পালাতে চাইবে। এদেশে আমরা আরো বেশি লোকজন চাই না তবে আমরা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাই যেখানে মানুষ আসতে চাইবে। সবাই যদি আপনার বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে চায়, তার মানে আপনার বাড়িটি ভয়ঙ্কর অবস্থায় রয়েছে।
বিষয়টা এখনও এমনই যে বেশিরভাগ লোক দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। আমাদের এমন একটা সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর প্রয়োজন যেখানে একেবারে সাধারণ ব্যাপারগুলো থেকে যেমন আপনি নিজের চটিজোড়া কীভাবে একসাথে করে রাখেন থেকে শুরু করে আপনি রাস্তা দিয়ে কীভাবে গাড়ি চালান, লোকের সাথে কথা বলেন অবধি, এগুলো যদি পাল্টে যায়, তখন মানুষ চাইবেই আসতে। আমাদের এটা ঘটানো প্রয়োজন। নচেৎ, আমরা লোকজনকে বেঁধে রাখছি দেশে কারণ আমরা ভয় পাচ্ছি যে সবাই ছেড়ে চলে যাবে। এটা তো একটা কারাগার।সবাই যদি আসতে চায়, সেটাই বাসভবন, সেটাই একটা জাতি।
এটা আমাদের করা দরকার আর আমাদের শুধু এরকম আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে বলেই যে এটা হয়ে যাবে, তা নয়। কাজের কাজটা বস্তুত সব স্তরেই হওয়া দরকার। অর্থনৈতিক কাজটা বিরাটভাবে হচ্ছে, এটা ঠিক দিকেই এগোচ্ছে। তবে এদেশে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ব্যক্তি-স্তরে, সচেতনতার সাপেক্ষে যা হওয়া দরকার তা যদিবা দ্রুত গতিতে নাও হয়, অন্তত সমান তালে হওয়া প্রয়োজন। এটা যদি না হয়, অনুকূল অর্থনীতি কল্যাণের চেয়ে আরো যন্ত্রণা নিয়ে আসবে।.
আমাদের এটা করতে হবে যাতে রাস্তা দিয়ে যাঁরা হাঁটছেন তাঁরা যেন পাশের মানুষটির জন্য আরেকটু বেশি সচেতনতা ও প্রযত্ন নিয়ে হাঁটেন। আপনি কি এটা করতে রাজি আছেন? নিস্তব্ধভাবেই কেবল, এটা যে হওয়া প্রয়োজন - সেবিষয়ে সবাইকে প্রতিনিয়ত সচেতন থাকতে হবে। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, আপনার প্রতিনিয়ত সচেতন থাকা উচিত। আপনার করা প্রতিটা কাজে আপনাকে দেখতে হবে যে এটা যাতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন পৃথিবীটা অন্যরকম একটা জায়গা হয়ে যাবে।
Editor’s Note: “Bha-ra-ta: The Rhythm of a Nation” includes more of Sadhguru’s insights on Bharat, its past, present and future, and the profundity of its culture. The ebook is available on a “Pay As You Wish” basis.