বিশ্ব-মহামারী পরবর্তী সময়ে উন্নততর বিশ্ব সম্বন্ধে সদগুরুর চিন্তা ভাবনা
কিভাবে কোভিড-১৯ এর প্রতিকূলতাকে বিশ্বের কর্মপদ্ধতি পুনর্বিন্যাসের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সেই সম্পর্কে সদগুরু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ব্যক্ত করছেন।
'লিভিং প্লানেট রিপোর্ট' বলছে যে বিশ্বের সাতশ কোটি লোক যদি একজন সাধারণ আমেরিকান ব্যক্তির মতো জীবন যাপন করে তাহলে আমাদের ৪.৫টি গ্রহের প্রয়োজন হবে। কিন্তু আমাদের কাছে একটিই মাত্র আছে। পৃথিবীর সংস্কার সাধন করার জন্য আমরা বড্ড বেশি সময় ব্যয় করেছি। সাধারণভাবে কোনকিছু সংস্কার করা মানে তাকে উন্নত করা। কিন্তু আমরা ধ্বংসাত্মক ভাবে এর সংস্কার করেছি এবং তা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে আমরা যদি 'যা চলছে চলুক'-এই রীতিতে চলি, তাহলে আগামী কুড়ি থেকে তিরিশ বছরের মধ্যে এক মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে চলেছে।
অন্তত এই ভাইরাস বিরতির বোতামে চাপ দিয়েছে এবং অর্থনৈতিক ইঞ্জিনকে মেরামত করার এটাই সুযোগ। অর্থনৈতিক ইঞ্জিন যখন চলমান, আমরা সেটা মেরামত করতে পারি না। কিন্তু এখন এটা মেরামত করার জন্য খুব ভালো সময় এবং এটা বিবেচনা করার জন্যও যে কি করে অন্যরকমভাবে আমরা এই বিশ্বকে পরিচালনা করতে পারি।
সচেতনভাবে ব্যয় করা
এখন উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এই সম্প্রসারণ কোথায় চলেছে ? উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি সম্বন্ধে আমাদের মূল ধারণাকে পুনর্মূল্যায়ন করা অত্যন্ত আবশ্যক। সমৃদ্ধি মানে শুধুই আরও বেশি বেশি নয়। জীবনধারণের জন্য একমাত্র এই গ্রহটিই বর্তমান। নিরন্তর আরও বেশির চাহিদা নিয়ে আমরা চিরদিন চালিয়ে যেতে পারব না। সমাজকে ভাবতে হবে কিভাবে আমাদের যা আছে তা দিয়েই সকলের মঙ্গল সাধন করা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতবর্ষের মতো একটি দেশে যারা স্মার্টফোন কেনেন তাদের মধ্যে ৪০শতাংশ মানুষই মাত্র এক বছরের জন্য তা ব্যবহার করেন। ভারতবর্ষে ৫০কোটিরও বেশি স্মার্টফোন রয়েছে যেগুলো ব্যবহার হচ্ছে না। লোকের বাড়িতে কোথাও তা পড়ে রয়েছে, কারণ তারা নতুন মডেলের ফোন কিনেছেন।
আমরা এমন একটি আইন করি না কেন যে তুমি যদি একটি ফোন কেনো তাহলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাকে তা ব্যবহার করতে হবে। অথবা এটা যদি ভেঙে যায় তাহলে তোমাকে সেটা জমা দিতে হবে। একইভাবে তুমি যদি একটি গাড়ি কেনো, সেক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট সময় অথবা মাইলেজ পর্যন্ত তা ব্যবহার করতে হবে। কাঁচামাল যেমন স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আমাদের সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন যাতে কোন দেশই তাদের উৎপাদনের মাত্রা আগামী ২৫বছর আর বাড়াতে না পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে সামান্য ছাড় দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছে তাদেরও থামতে হবে। তা নাহলে আমাদের ব্যয় অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠবে।
একটা সময় ছিল যখন প্রত্যেকের ছটি বা আটটি সন্তান । বর্তমানে সবাই একটি বা দু'টি তে নেমে এসেছেন। অনেকে আবার একেবারেই সন্তান চাইছেন না। এটি যদি আমরা সন্তানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি তাহলে ফোন, গাড়ি বা অন্য সবকিছুর ক্ষেত্রে কেন করতে পারি না? আমরা যদি এখনই এটা না করি, তাহলে এভাবে আরও ২৫ থেকে ৩০ বছর চলতে পারে - তারপর আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে পৌঁছাব যা এই ভাইরাসের থেকেও মারাত্মক হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাগুলি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, তখন আমরা যে গভীর সমস্যার সম্মুখীন হব -তা এই ভাইরাসের তুলনায় অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
লোকে অবশ্য বলবে, "সদগুরু আপনি আঘাতের উপর অপমান যোগ করছেন। আমরা আমাদের শিল্প নিয়ন্ত্রণে রাখতে জানি না। আমরা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে পারি না। এখন আপনি উৎপাদন কমানোর কথা বলছেন।" আমি না, প্রকৃতি তা চাইছে। ভালো হয় যদি আমরা সেই বার্তাটি মন দিয়ে শুনি।
শিক্ষার বিবর্তন
বর্তমান সমাজে বিদ্যালয়গুলি এবং তাদের শিক্ষা পদ্ধতি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। এই ত্রুটির জন্য আরও অনেক সমস্যা তৈরী হয়েছে। এখন কিন্ডারগার্টেন থেকেই শিশুদের শেখানো হয় "তোমাকে প্রথম হতে হবে"। এটি একটি ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া কারণ কেবল একজনই প্রথম হতে পারে- যা তোমাকেই হতে হবে। তার অর্থ, তুমি একজন নিজেকে ক্ষমতাশালী ভাবার বাতিকগ্রস্ত ব্যক্তি। দুর্ভাগ্যবশত এই ধ্বংসাত্মক পদ্ধতি সর্বত্রই চলছে। মূলত তা বিদ্যালয়গুলিতে উৎপন্ন হয়, এবং অনেক বড় আকারে বিশ্বের সর্বত্র তা প্রকাশিত হয়।
প্রায় ২০০বছর আগে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় "গণ শিক্ষার" সূত্রপাত ঘটে, যা ছিল তৎকালীন শিল্পায়নের যোগান দেওয়ার জন্য। সে সময় সবার জন্য একই প্রকারের শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু হয় যা ব্যক্তিগত অনুভূতি, স্বাতন্ত্র এবং প্রতিভাকে কোন গুরুত্ব দেয় না। এটি একটি সর্বজনীন প্রক্রিয়া ছিল, যার মাধ্যমে প্রত্যেককেই তৈরী করা হত অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার বা বৃহত্তর অর্থনৈতিক ইঞ্জিনের অংশ হওয়ার জন্য।
আমি যখন স্কুলে ছিলাম তখনও আমি বুঝতাম না যে কেন সবাই একটি ঘরে বসে একজন ব্যক্তিকে বই থেকে পড়ে শোনে। তাই আমি খুব কমই সেখানে যেতাম। এই কার্যকলাপ আমি কখনোই অনুধাবন করতে পারিনি তাই আমি সবসময় বাইরে বাগানে বসে থাকতাম। আমরা কত লক্ষ লক্ষ বর্গফুট বিল্ডিং নির্মাণ করেছি শুধু মানুষকে শিক্ষা প্রদান করতে! একসময় আমরা এটা প্রয়োজন মনে করেছিলাম, কারণ তখন আমরা সবকিছুই গণ উৎপাদন করার অবস্থায় ছিলাম; তা সে শিল্প বা শিক্ষা যাই হোক না কেন। কিন্তু বর্তমানে জ্ঞান বা তথ্য সর্বত্র সহজলভ্য। এখন এমন একজনকে প্রয়োজন যিনি মানুষকে তাদের জীবনে যেটা মহত্বপূর্ণ এমন কিছুর জন্য কঠোর চেষ্টা করতে অনুপ্রাণিত করবেন।
শিক্ষার অর্থ কেবলমাত্র আমাদের মাথায় স্তুপীকৃত তথ্য নয় বরং মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন। বর্তমানে মানুষ হিসাবে আমাদের উন্নতি সাধন এবং চেতনার বিস্তার ঘটছে না। শিক্ষা এখন মূলত তথ্য সংগ্রহ করা, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এবং চাকরি পাওয়া। কয়েক দশক আগেও বিশ্বের অধিকাংশ স্থানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি হয়তো এমন ছিল যে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল চাকরি পাওয়া। কিন্তু এখন যখন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে তখন এই চিন্তাধারার পরিবর্তন হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র কর্মসংস্থান নয় বরং ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধন।
১০ শতাংশ বেশি সচেতন এক বিশ্ব
কিভাবে আমরা এখন বাস করছি তার একটা ধারণা দেওয়া যাক: প্রতিদিন প্রায় আট হাজার শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়। ৮০ কোটি মানুষ, যারা প্রতিরাতে অভুক্ত অবস্থায় শুতে যান তাদের সবাইকে খাবার দেওয়া সম্ভব মাসিক ৯৭ কোটি থেকে ৯৮কোটি ডলারে। আর এই একই পরিমাণ অর্থ বিশ্বে ভিডিও গেমসের জন্য ব্যয় হয়। বিশ্বে মদ, তামাকজাত দ্রব্য এবং মাদকের জন্য যে অর্থ ব্যয় হয়, তা খাদ্যের জন্য ব্যয়িত অর্থের প্রায় সমপরিমাণ। মানুষ অভুক্ত থাকার কারণ খাদ্যের অভাব নয়। তার কারণ আমরা বিকৃত মস্তিষ্ক হয়ে পড়েছি।
আমরা অভূতপূর্ব প্রাচুর্যের এবং প্রযুক্তি বিদ্যার অধিকারী যা আগে কখনও ছিল না। আমাদের দক্ষতা ও জ্ঞানের সম্ভার এবং বিজ্ঞানের উপর পারদর্শিতা অতুলনীয়। বিশ্বের সমস্ত সমস্যার মোকাবিলা করার মত প্রযুক্তি, সম্পদ এবং দক্ষতা আমাদের আছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে আজকের মতো এত সক্ষম মানুষ এর আগে আর কখনো ছিল না। মানুষের মধ্যে কেবল সচেতনতার অভাব। আমাদের প্রয়োজন এক সচেতন মানবজাতি, এক সচেতন বিশ্ব গড়ে তোলার। আমরা যদি বর্তমানের থেকে অন্তত ১০শতাংশ বেশি সচেতনতার সঙ্গে কাজ করি তাহলেই কোভিড- পরবর্তী বিশ্ব এক অসাধারণ জগৎ হয়ে উঠবে। একটি প্রজন্ম হিসেবে এই সম্ভাবনা আমাদের সামনে রয়েছে, আমরা সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপায়িত করব কিনা- সেটাই বড় প্রশ্ন।