কিছুই পাওয়ার নেই - একটি জেন গল্প
আত্মজ্ঞানী এক জেন সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ হয় অন্য একটি মঠের এক শিক্ষানবিশের সাথে এবং তিনি তার মঠ থেকে কি পেয়েছেন শিক্ষানবিশের এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন- কিচ্ছু নয়!
কাহিনী :
ষষ্ঠ জেন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত এক শিষ্য কাকসি নামক এক মঠে যোগদান করেন এবং গুরুর পথনির্দেশ অনুসরণ করে আত্মজ্ঞান লাভ করেন।
গুরু তাকে সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে বলেন, তাই তিনি তার যাত্রা শুরু করেছিলেন। একটি শহরে অন্য একটি মঠের এক শিক্ষার্থী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রশ্ন করেন, "আপনি কোথা থেকে আসছেন?"
আত্মজ্ঞানী শিষ্যটি বললেন, "আমি ষষ্ঠ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত কাকসি মঠ থেকে আসছি"।
"ওই মঠে আপনি কি পেয়েছিলেন?"
শিষ্যটি বললেন, "সেখানে এমন কোন কিছুই ছিল না যা আমার কাছে কাকসি যোগদানের আগে ছিল না,"।
"তাহলে আপনি সেখানে গিয়েছিলেন কেন?"
আমি যদি সেখানে না যেতাম তাহলে আমি জানতাম কি করে যে সেখানে এমন কোন কিছুই ছিল না, যা আমার কাছে ইতিপূর্বে ছিল না?"
সদগুরুর ব্যাখ্যা:
সদগুরু : আত্মজ্ঞান লাভ করা কোন কিছু আয়ত্ত করা নয়। বা এক লাফে একটা লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া নয়। একটা পর্বতশিখরে পৌঁছনো নয়। এটা শুধুমাত্র নিজেকে উপলব্ধি করা, ব্যাস এটুকুই।যখন আপনি সত্যকে উপলব্ধি করেন যা ইতিপূর্বেই বিদ্যমান, আমরা সেটাকে বলি আত্মজ্ঞান। এটা ঠিক এইরকম যেন আপনার সামনে কিছু একটা সবসময়ই ছিল অথচ আপনার চোখে পড়ে নি, আর এখন হঠাৎ সেটা আপনি লক্ষ্য করেছেন।
আপনি একটা মিথ্যা সৃষ্টি করতে পারেন, কিন্তু আপনি একটা নতুন সত্য সৃষ্টি করতে পারেন না। যা ইতিপূর্বেই রয়েছে, আপনি কেবল তার ভেতরে ডুব দিতে পারেন এবং সেটা উপলব্ধি করতে পারেন। এটাই আত্মজ্ঞান লাভ করা বা মুক্তি।
শুধুমাত্র এটা উপলব্ধি করার জন্য যে এমন কিছু আছে যেটাকে 'জানা' বলা হয়, আপনার একজন পূর্ণ আত্মজ্ঞানীর কাছে যাওয়া প্রয়োজন। তা না হলে আপনি নিজে নিজেই কোন কিছু কল্পনা করবেন আর এটা বিশ্বাস করবেন যে আপনি সব জানেন। অন্য কথায়, আপনাকে অবশ্যই প্রথমে এটা বুঝতে হবে যে আপনি আত্মজ্ঞান লাভের অর্থ কি তা জানেন না। সমস্যাটা হল, মানুষ এমনকি এটাই বোঝেননা যে তারা জানেন না।
এটা আমার শৈশবের সমস্যা ছিল যে আমি কোন কিছুই জানতাম না! আমার হাতে একটা পাতা নিলে শুধুমাত্র তার দিকে তাকিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। আমাকে যদি বাড়িতে এক গ্লাস জল খেতে দিত, আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম সেটার দিকে তাকিয়ে, জল না খেয়ে। আমার বিছানায় উঠে বসে আমি সারারাত অন্ধকারের দিকে চেয়ে থেকে যেতাম। আমি সব সময় কিছু না কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
আমার চারপাশে লোকজন ভাবতো আমার বোধহয় কোন এক ধরনের মানসিক সমস্যা আছে। অন্যরা ভাবতো কোন ভূত বা প্রেতাত্মা বুঝি আমার উপর ভর করেছে। কিন্তু আসলে আমি কিছুই জানতাম না বলে কোন কিছুর উপর চোখ পড়লে, আমি তার দিকে তাকিয়েই থেকে যেতাম। কোন কিছুকে জানবার জন্য আমার আর অন্য কোন উপায় জানা ছিল না।
ইতিমধ্যে আমার চতুর্পাশে লোকজনদের দেখে মনে হতো তারা সবকিছুই জানেন। আর মনে হতো তাদের জ্ঞানের ফলে তারা খুব আনন্দে জীবন কাটাচ্ছেন। এখানে যা কিছু আছে সবই তারা জানতেন, এমনকি সে সবকিছু সম্বন্ধেও যা চোখে দেখা যায় না। তারা ভগবানকে জানতেন, স্বর্গ কি সেটা জানতেন, তারা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জানতেন। আমি অনেক লোককে বলতে শুনেছি যে ভগবানের সঙ্গে তাদের কথোপকথন হয়।
আমি এটা জানতে উৎসুক হয়ে উঠেছিলাম যে ভগবানের সঙ্গে দেখা করার এবং তার সঙ্গে কথা বলার পর তাদের কি হত এবং তারা কেমন ব্যবহার করতেন। তাই আমি অনেকবার মন্দিরের বাইরে বসে থাকতাম এবং মন্দিরে যারা ঢুকতেন এবং বের হতেন তাদের খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। কিন্তু মন্দিরের বাইরে যারা বেরিয়ে আসতেন তাদের দেখে মনে হতো তারা শুধুমাত্র লোকেদের সম্বন্ধে পরচর্চায় এবং গুজব ছড়াতে ও শুনতে আগ্রহী।
ভারতবর্ষের মন্দিরগুলিতে অন্য কারোর সঙ্গে আপনার জুতো চলে যাওয়াটা একটা সাধারন ব্যাপার। তাই আমি দেখেছি - লোকজন, যারা জুতো হারাতেন, ভগবানকে প্রচন্ডভাবে গালমন্দ করতেন।
আমার মনে হত যে সব লোকেরা রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসেন তাদের অনেক বেশি খুশি ও এবং সন্তুষ্ট দেখায়, যারা মন্দির থেকে বেরিয়ে আসেন তাদের তুলনায়।ঈশ্বর বনাম দোসা - এতে দোসার জিৎ হত সব সময়।
সেই সময় আমি জানতাম না ঈশ্বর কি বা ঈশ্বরের প্রকৃতি কি রকম। আর অবশ্যই আমিও দোসা পছন্দ করতাম। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম যে সৃষ্টির উৎস যাই হোক না কেন সেটা দোসার থেকে অনেক বড় এবং অসামান্য ঘটনা। কিন্তু বাস্তবে দোসাই মানুষকে বেশী তৃপ্তি দিত।
আমি অনুভব করেছিলাম, এই পরিস্থিতিতে কিছু একটা মৌলিক ভুল রয়েছে। আমার এটা বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিল যে বাস্তবে কেউই কিছুই জানতেন না। তাদের কল্পনা থেকে তারা কেবলমাত্র সন্তুষ্টি লাভ করেন। প্রচলিত ব্যাখ্যা এবং বিশ্বাসের কারণে, লোকজন এমনকি এটা মানতেই রাজি নন যে তারা জানেন না। আপনি যদি শুধুমাত্র এটা বোঝেন যে আপনি জানেন না, তবেই আপনার যা জানেন না -তা জানার ইচ্ছা জাগবে। এ অবস্থায়, অজানা কে জানবার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
যথার্থ গুরু বা শিক্ষকের কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্য নতুন কিছু পাওয়া নয়। উদ্দেশ্য তার সাহায্য পাওয়া এটা উপলব্ধি করার জন্য- যা আপনার অন্তরে অবস্থিত অথচ আপনি লক্ষ্য করেন নি।
যা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল সেটা আপনার পক্ষেও সম্ভব। এটা আপনার প্রতিবেশীর জন্যও সম্ভব এবং এমনকি আপনার শত্রুর পক্ষেও। আপনাকে নতুন কিছু অর্জন করতে হবে না।