মাটির দুরবস্থা এবং আমাদের উপর এর প্রভাব
সদগুরু আমদের কাছে আবেদন করছেন, বাস্তুতন্ত্রকে ভবিষ্যতের সমস্যা মনে করার ভুল যেন আমরা না করি। প্রাকৃতিক পরিবেশের গুণমানই আমাদের জীবনের গুণমান নির্ধারণ করে।
অর্থনীতি হ'ল আমাদের জীবন ধারণের একটি জটিলতর সংস্করণ। সহজ সরল জীবন যাপনের অর্থ হ'ল খাওয়া, ঘুমানো, বংশবিস্তার এবং মৃত্যু। এটাই এখন ভীষণ জটিল করে দেওয়া হয়েছে। আমি এর বিপক্ষে নই, কিন্তু মানুষ মনে করেন অর্থনীতি আজকের চিন্তা আর বাস্তুতন্ত্র আগামীকালের চিন্তা। এই ধারণাটাই বদলাতে হবে।
বাস্তুতন্ত্র আজকের সমস্যা এবং আজকের চিন্তা। স্টক- মার্কেটের ওঠানামা বা কোনও বিশেষ সমাজ বা রাষ্ট্রের বৃদ্ধির সূচকের শতাংশের কারণে আমাদের জীবন সুন্দর হয় না। আমদের জীবন সুন্দর, তার কারণ আমরা পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছি, পরিস্কার জল পান করছি এবং শুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি। এটা তো সম্পূর্ণ ভুলেই গেছি!
সব কিছু বিষময়
আজকাল যে খাবার আমরা খাই, তা রাসায়নিকে ভরা। যে জল আমরা পান করি, তা দূষিত। আর বাতাস তো অবশ্যই বিষাক্ত। আমি বিশ্বাস করি আগামী দশ থেকে পনের বছরের মধ্যে বাতাসকে শুদ্ধ করা হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি সামগ্রিক আন্দোলন ঘটছে। কিন্তু বিপুল সমস্যা হল, মাটি এবং জল।
মাটিতেই প্রাণ বিবর্তিত হয়। আপনি এবং আমি, আমরাও সামান্য মাটি মাত্র। যা ছিল মাটি, সেটিই খাদ্যে পরিণত হয়েছে। আবার যা ছিল খাদ্য, সেটিই রক্তমাংসে পরিণত হয়েছে। আমরা যদি এখনও সেটা বুঝতে না পারি, যখন আমাদের মাটি চাপা দেওয়া হবে- তখন বুঝতেই হবে। অধিকাংশ মানুষ একটু বেশিই দেরি করে ফেলে এটা বুঝতে, কিন্তু কোনও একদিন প্রত্যেকেই বোঝেন।
দুর্ভাগ্যবশত, বাস্তুতন্ত্রের প্রসঙ্গে অধিকাংশ মানুষই মাটিকে অবহেলা করে থাকেন। এই পৃথিবীর মাটির আমরা যে ক্ষতি করেছি, তা সাংঘাতিক। অন্যান্য জিনিস, যেমন কোথাও বরফ গলছে- সেটা হয়তো দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মাটির যে ক্ষতি আমরা করেছি তা খুবই ভয়ঙ্কর।
ক্রমহ্রাসমান পুষ্টিগুণ
ভারতে আমরা যে শস্য এবং সবজি উৎপাদন করি, তার পুষ্টিমান গত পঁচিশ বছরে প্রায় তিরিশ শতাংশ কমে গেছে। সেই জন্যই যা কিছুই খান না কেন, মানুষ পূর্ণ আকারে বিকশিত হচ্ছে না।
চিকিৎসকরা বলছেন, মাংস না খেলে আপনি যথেষ্ট পুষ্টি পাবেন না। একদিক থেকে তারা পুরোপুরি ভুল নন। নিরামিষ খাবার তার পুষ্টিগুণ হারিয়েছে, যেভাবে সেগুলো উৎপাদন করা হচ্ছে তার জন্য। তারা যা হোক কিছু একটা দিয়ে গাছ বড় করছে, যাতে করে এগুলো খাদ্যের মতো দেখায়। এগুলো প্রকৃত খাদ্য নয়। এগুলো সবই ফালতু জিনিস – যা বিক্রি হচ্ছে। এরকম ঘটার কারণ হ'ল, মাটির গুণমান নাটকীয় ভাবে কমে গেছে।
আপনি কেবল রাসায়নিক সার আর ট্রাক্টর ব্যবহার করে মাটিকে সমৃদ্ধ রাখতে পারবেন না। জমিতে পশুর প্রয়োজন আছে। সেই প্রাচীন কাল থেকে, যখন থেকে আমরা চাষ করছি, শুধু শস্যটাই আমরা নিয়ে আসতাম। গাছের বাকি অংশ এবং পশুর বর্জ্য সব মাটিতেই ফিরে যেত।
আজকাল আমরা সবকিছুই তুলে আনছি এবং কিছুই ফিরিয়ে দিচ্ছি না জমিতে। আমরা ভাবছি খানিকটা ফার্টিলাইজার ছড়িয়ে দিলেই সব হয়ে যাবে। এই কারণেই খাদ্যের গুণমান এবং এর পুষ্টিগুণ নাটকীয় ভাবে কমে যাচ্ছে।
আমাদের খাদ্য উৎপাদন করার ক্ষমতাই ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, কারণ আমরা জমিকে মরুভূমিতে পরিণত করছি। আমরা মাটিকে বালিতে রূপান্তরিত করে ফেলছি কারণ এতে কোনও জৈব পদার্থ থাকছে না- কোনও গাছের পাতা বা পশুর বর্জ্য নেই।
রাসায়নিক সারের প্রকৃত বিপদ
প্রায় চল্লিশ বছর আগে যখন আমি চাষ করছিলাম, রাসায়নিক সারের কম্পানিগুলো গ্রামে এসে এর গুনাগুণ এবং এটা কী কী করতে পারে – এ ব্যাপারে বক্তৃতা দিত। তাদের কথা শুনে আমি মাথা ঘোরাতে পারতাম না।
নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে, মাটিতে যে রাসায়নিক সার দেওয়া হয় তা নয় থেকে বারো বছর থেকে যাবে। কিন্তু উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে এটা তিন থেকে চার মাসের বেশি থাকবে না। আমরা কোথাও থেকে এই ধারণাটা পেয়েছিলাম যে আমরা জৈব উপাদান ছাড়াও খাদ্য উৎপাদন করতে পারি। এটা একরকম অবিশ্বাস্য।
জৈব উপায় ছাড়া অন্য ভাবে কী খাদ্য উৎপাদন করার কোনও পথ আছে? এক কথায় না। একমাত্র পশুর বর্জ্য এবং চাষের বর্জ্য মাটিতে ফিরিয়ে দিয়েই মাটিকে সংরক্ষণ করা যাবে। একমাত্র এই ভাবেই দীর্ঘ সময়ের জন্য মাটিকে রক্ষা করা সম্ভব।
মাটিকে পুনরুদ্ধার করলেই সবকিছু ঠিক থাকবে
আমরা যদি আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরে দৃঢ় পদক্ষেপ নিই, তবেই আগামী পঁচিশ থেকে তিরিশ বছরে মাটিকে আমরা মোটামুটি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারব। কিন্তু যদি আমরা অপেক্ষা করি এবং পঞ্চাশ বছর পর উদ্যোগ নিই, তাহলে একশো থেকে দেড়শ বছর লাগবে মাটিকে বদলাতে। তার মানে মাটির এই খারাপ অবস্থার জন্য চার থেকে পাঁচ প্রজন্মের মানুষ ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাবে।
যদি আমরা মাটিকে ঠিক করে ফেলতে পারি, জলও ঠিক থাকবে, বাতাসও ঠিক থাকবে আর অন্য সব কিছুই ঠিক থাকবে। মাটিকে অবশ্যই সমৃদ্ধ এবং ভাল রাখতে হবে কারণ আমাদের শরীরতো ঐ একই মাটি। আমাদের সন্তানদের জন্য সমৃদ্ধ মাটি ও জল সম্পন্ন পরিবেশ রেখে যেতে পারলে সেটাই হবে তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পদ। একমাত্র মাটির গুণমান রক্ষা করতে পারলে তবেই এই পৃথিবীর এবং সকল জীবনের গুণমান স্থায়ী হবে।