জীবনে ভালো-খারাপ বলে কিছু হয় না
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে কৃষ্ণ তাঁর পুরো সেনাবাহিনী দুর্যোধনকে প্রদান করেছিলেন। সদগুরু এই পরিস্থিতির বর্ণনা করছেন - এটি বোঝাতে যে জীবনে ভালো-খারাপ বলে কিছু হয় না।
প্রশ্নকর্তা: কৃষ্ণ যদি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলেন, তবে কেন তিনি নিজেকে বা তার সেনাবাহিনী দুর্যোধনকে প্রদান করেছিলেন?
সদগুরু: কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এমন ছিল যে কেউই নিরপেক্ষ থাকতে পারতেন না। আপনাকে এক পক্ষ বেছে নিতেই হত। যাদবদের প্রধান হওয়ার সুবাদে কৃষ্ণকেও হয় পাণ্ডব বা কৌরব কাউকে তার সেনা দিতেই হত। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই যুদ্ধ চাননি এবং নিরপেক্ষ থাকতেই পছন্দ করতেন, কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না। হস্তিনাপুরের বিরুদ্ধে তাঁর কোনও বিদ্বেষ ছিল না। তিনি যে কেবল দুর্যোধনকেই বেছে নিয়েছিলেন তা নয়; ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য - অনেক বরিষ্ঠ নেতারা অপর পক্ষে ছিলেন। তিনি তাদের বিপক্ষে ছিলেন না এবং তারাও তাঁকে অগাধ শ্রদ্ধা করতেন। অন্য পক্ষে দুর্যোধনের সাথে বহু শ্রদ্ধেয় নেতারা ছিলেন এবং পাণ্ডবদের সাথেও তাই, তাদের মধ্যে দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। যখন একজন আত্মীয় এসে আপনার সাহায্য চায়, ক্ষত্রিয় ধর্ম হিসেবে "না" বলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ক্ষত্রিয় শ্রেণীর ধর্ম ছিল ক্ষত্র তেজ এবং আধ্যাত্মিক শ্রেণীর ধর্ম ছিল ব্রহ্ম তেজ। কৃষ্ণ ক্ষত্রিয় এবং ব্রাহ্মণদের মধ্যে কিছুটা মৈত্রী স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। এইসব নির্দেশিকা এবং বিধিগুলি সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। তখন বলা হত- একজন ব্রাহ্মণকে অবশ্যই দিনে নির্দিষ্ট কয়েক ঘন্টা বেদ অধ্যয়ন করতে হবে। যদি একই ধর্ম কোনও ক্ষত্রিয়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া হত, তার হয়তো এটা করার যোগ্যতা নেই, এবং যদিও সে এটি করত- সে একজন ভালো প্রশাসক হতো না, আর দক্ষ যোদ্ধা তো নয়ই। অন্যান্য সব শ্রেণীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেই জন্যই তারা বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যারা সমাজে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু একসময় ক্ষত্রিয়রা অন্য মানুষদের এবং তাদের ধর্মকে বিবেচনা না করে কেবলমাত্র নিজেদের ধর্ম এবং নিজেদের ভালোর কথা চিন্তা করতে শুরু করে- যা সামাজিক সম্প্রীতিকে ব্যাহত করে। কৃষ্ণ এবং ব্যাসমুনি ক্ষত্র তেজ এবং ব্রহ্ম তেজকে একত্রে আনার প্রচেষ্টা করেছিলেন যাতে তারা সম্মিলিত শক্তি হিসাবে সকলের উপকারের জন্য কাজ করতে পারে।
যেহেতু ক্ষত্র তেজ অনুসারে কোন আত্মীয় এসে কিছু চাইলে আপনি "না" বলতে পারবেন না, কৃষ্ণ তাঁকে এবং তাঁর সেনাবাহিনীর মধ্যে তাদের বেছে নিতে বলেছিলেন। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেনা অবশ্যই একটি উত্তম নির্বাচন ছিল। দুর্যোধন বিশ্বাস করতেন যে সেনাবাহিনী নেওয়াই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ, যদিও তিনি প্রথমে বেছে নেওয়ার সুযোগ পান নি এবং তা নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন। যখন বেছে নিতে বলা হয় পাণ্ডবরা কৃষ্ণকে বলেছিলেন, “আমরা বাঁচি কিংবা মরি - আমরা যদি বেঁচে থাকি আমরা তোমার সাথে বাঁচতে চাই। আমরা যদি মারা যাই তবে আমরা তোমার সাথেই মরতে চাই। তোমাকে ছাড়া আমরা কী করব?” এবং এটাই তাদের জন্য পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছিল।
এখন আপনার প্রশ্ন হ'ল, "কৃষ্ণ যদি ধর্মের পক্ষে ছিলেন তবে তিনি কি করে নিজের সৈনশক্তি অধর্মের পক্ষে রাখতে পারেন?" তিনি কোন নৈতিকতাবাদী ব্যক্তি ছিলেন না যিনি কারও সম্পর্কে ভালো বা খারাপ অভিমত পোষণ করবেন। তিনি নাতো এটা বিশ্বাস করতেন যে পাণ্ডবরা সম্পূর্ণভাবে খাঁটি মানুষ, এবং না কৌরবরা ছিল চরম দুষ্ট। তিনি এভাবে জীবনকে দেখেন নি। তিনি সবসময় কৌরবদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতি তাঁর একজন ভক্ত ছিলেন। তিনি কৌরবদের পুরোপুরি খারাপ হিসাবে দেখেন নি- তিনি শুধুমাত্র দেখেছিলেন যে তারা সে সময় অনেক খারাপ কাজ করছিল এবং তিনি চাইছিলেন সেগুলো যদি বন্ধ করা যায়। তার মানে এই নয় যে তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রকার ঘৃণা বা ক্ষোভ পোষণ করতেন বা তাদের মন্দ হিসাবে বিবেচনা করতেন। তিনি বুঝেছিলেন যে মানুষ চিরদিনই সব কিছুর সংমিশ্রণ। এই জন্যই আপনাকে নিজের ভিতর ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হতে হবে; অন্যথায় আপনি অধর্মে পরিণত হবেন। যে কোনও মানুষ তার জীবনের যে কোনও মুহুর্তে অধর্ম হয়ে উঠতে পারে। এমন কোনও বীমা নেই যে আপনি কখনই অধর্মের মধ্যে পড়বেন না। আপনাকে সচেতন হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা করতে হবে; ন্যায়নিষ্ঠ পথে চলার প্রচেষ্টা করতে হবে, তা নাহলে আপনি সহজেই পিছলে যাবেন। এটি প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যতক্ষণ না আপনি এমন একটি চেতনার স্তরে পৌঁছান যেখান থেকে আপনার আর পতন হবে না।
নানাভাবে কৃষ্ণ চেষ্টা করেছিলেন দুর্যোধনকে ধর্মের পথে নিয়ে যেতে। এমনকি তিনি যখন তাঁর এবং তাঁর সেনাবাহিনীর মধ্যে বেছে নিতে বলেছিলেন, তখনও তিনি যুদ্ধ এড়ানোরই চেষ্টা করছিলেন। এক রকম ভাবে দুর্যোধনকে সেনাবাহিনী দেওয়া অত্যন্ত বিচক্ষণ পদক্ষেপ ছিল। তাতে করে দুর্যোধন ভেবেছিলেন, "কৃষ্ণ আমার পক্ষে আছেন", ভেবেছিলেন পাণ্ডবরা এক লক্ষ সেনার শক্তিশালী বাহিনীর পরিবর্তে একজন মানুষকে নিয়ে নির্বোধের কাজ করেছে। এটা দুর্যোধনের সবকিছু বন্ধ করে শান্তি আনার একটা উপায় হতে পারত, কিন্তু সেটা ব্যর্থ হয়।
সেইটি হয়ে উঠুন
প্রশ্নকর্তা: সদগুরু, আপনি তিনটি দিকের কথা বলছেন- একটি হ'ল কৃষ্ণের ক্রীড়াশীলতা, দ্বিতীয়টি হলো সকলকে আপন করে নেওয়া এবং তৃতীয়টি হল ভালবাসা এবং ভক্তি। এই প্রসঙ্গে আমার তিনটি প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমত, সাধনার ফলে যে তীব্রতা তৈরী হয় সেটি না হারিয়ে কি ভাবে ক্রীড়াশীল থাকা যায়? দ্বিতীয়ত, আমি ক্রমশঃ বন্ধু এবং পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। আমার নিজের মতো থাকতে ইচ্ছে করে। সকলকে আপন করে নেওয়া বলতে কি বোঝায় সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এবং তৃতীয়ত, আমার মনে হয় মনের নিরন্তর অতি-সক্রিয়তা কিংবা নিজস্ব অভিমত একজনের ভক্তি এবং ভালোবাসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাহলে কীভাবে এই তিনটি দিক প্রতিদিনের জীবনে প্রয়োগ করা যেতে পারে?
সদগুরু: এগুলো প্রয়োগ করা যায় না - এগুলো অর্জন করা যেতে পারে। এগুলি কোনও ধরণের নীতি বা কৌশল নয় যে আপনার জীবনে প্রয়োগ করবেন। আপনাকে সেটা হতে হবে। আপনাকে অন্তর্ভুক্তি হতে হবে। আপনাকে প্রেম হতে হবে। এটি এমন কিছু নয় যা আপনি করতে পারেন বা ব্যবহার করতে পারেন। এটি এমন কিছু যার কাছে আপনি সমর্পণ করেছেন। এটিকে আপনার সবকিছু জ্বালিয়ে দিতে অনুমোদন দিয়েছেন। আপনি আর অধিক গুরুত্বপূর্ণ নন।
আপনি এখনও যেহেতু প্রয়োগের স্তরে রয়েছেন, যেহেতু আপনি কিছু ব্যবহার করতে চান- আমরা আপনাকে অনুশীলনগুলো দিয়েছি। আমার ইচ্ছে করে প্রোগ্রামের ভেতর থেকে যদি আমরা অনুশীলনগুলি বাতিল করে দিতে পারতাম। সেগুলো সুন্দর; সেগুলো নিশ্চিত ভাবে একজন মানুষকে বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়, কিন্তু লোকজন প্রোগ্রাম থেকে এবং সেখানে আমার সঙ্গ থেকে কি নিয়ে যেতে পারছে- তার মূল্যায়ন করে, সেটা বোকামি। ওভাবে তারা কোথাও পৌঁছাতে পারবেন না। হয়তো তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে, কিন্তু তারা জীবনভর তার বাইরে আর কিছুই জানতে পারবেন না।
প্রয়োগ করার কিছুই নেই। আলাদা করে নেওয়ার কিছু নেই। ধর্মপ্রাণ হওয়ার চেষ্টা করবেন না; প্রেমময় হওয়ার চেষ্টা করবেন না; অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবেন না। আপনি সেটা করতে পারবেন না। আপনাকে সেটা হতে হবে। ভালোবাসা করা যায় না। ভালবাসা আপনার চেয়ে অনেক-অনেক বেশি বড়। আপনি এর অংশ হতে পারেন। প্রেমে পড়ার কোনও পদ্ধতি নেই। আপনি যখন নিজেকে আর গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন না, তখনই প্রেম হবে। আপনি যদি নিজেকে নিয়ে মশগুল থাকেন তবে আপনার জীবনে প্রেমের কোনও সম্ভাবনা নেই। আপনি হয়তো সম্পর্ক গড়তে পারেন; দেওয়া- নেওয়া করতে পারেন, কিন্তু কিভাবে জ্বলতে হয় তা আপনি জানেন না। আপনি যদি জ্বলতে না জানেন তবে আপনার নিজস্ব কোনও আলো থাকবে না।
Editor's Note: Watch the Leela series, where Sadhguru explores the life and path of Krishna.
This article is based on an excerpt from the January 2014 issue of Forest Flower. Pay what you want and download. (set ‘0’ for free). Print subscriptions are also available.