মহাভারত পর্ব ১২: অশুভ সংকেতের মধ্যে কৌরব ভাইদের জন্ম
মহাভারতের এই পর্বে আমরা দেখবো ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের জন্মকে ঘিরে নানা অমঙ্গল সূচক ঘটনা। মুনি-ঋষিদের জ্ঞান ও তাঁদের দেওয়া নানা অশুভ পূর্বাভাস উপেক্ষা করে গান্ধারী ও তাঁর স্বামী তাঁদের প্রথম সন্তান সর্প-চোখী দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন।
সদগুরু: ধৃতরাষ্ট্র স্বভাবত অন্ধ ছিলেন - তাঁর স্ত্রী গান্ধারী স্বেচ্ছায় অন্ধ ছিলেন। ভ্রাতৃবধূদের কোনো সন্তান হওয়ার আগেই তিনি তাঁর স্ত্রীর সন্তান ধারণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন, কারণ নতুন প্রজন্মের প্রথম সন্তানই রাজা হবে। গান্ধারীর কানে কানে তিনি সোহাগের কত কথা শোনালেন- যাতে গান্ধারী কোনোভাবে তাঁকে একটি পুত্রসন্তান দেন। গান্ধারী গর্ভবতী হলেন। মাসের পর মাস গড়িয়ে গেল, ন’মাস থেকে দশ মাস হল, এগারো মাস হয়ে গেল - তাও সন্তান প্রসব হল না। তাঁরা অস্থির হয়ে উঠলেন। তখনই তাঁরা খবর পেলেন যে পাণ্ডুর প্রথম পুত্র - যুধিষ্ঠিরের জন্ম হয়েছে। ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী হতাশ হয়ে পড়লেন।
এক অশুভ জন্ম
যেহেতু যুধিষ্ঠির প্রথমে জন্মেছিলেন, স্বাভাবিকভাবে তিনিই রাজা হবেন। এগারো, বারো মাস কেটে গেল, তাও গান্ধারী সন্তান প্রসব করলেন না। তিনি বললেন, "কী এটা? এটা মৃত না জীবিত? এটা কি মানুষ না জন্তু?” হতাশ হয়ে তিনি নিজের পেটে আঘাত করতে লাগলেন কিন্তু তবুও কিছু হল না। তখন গান্ধারী তাঁর এক দাসীকে একটা লাঠি এনে তাঁর পেটে আঘাত করতে বললেন। এরপর তাঁর গর্ভপাত হল এবং কালো রঙের একটা মাংসপিন্ড বেরিয়ে এল। লোকজন সেটাকে দেখামাত্রই আঁতকে উঠল, কেননা এটা মানুষের শরীরের মত ছিল না - এটা যেন একটা অশুভ ও অমঙ্গল সূচক কিছু ছিল।
হঠাৎ করে গোটা হস্তিনাপুর শহর আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল কেননা তারা ভয়ংকর সব শব্দ শুনতে পাচ্ছিল - শেয়ালরা চিৎকার করছে; হিংস্র পশুরা রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে; দিনের বেলায় বাদুড় উড়ছে। লক্ষণগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে অশুভ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। মুনি-ঋষিরা এটা লক্ষ করলেন এবং হস্তিনাপুর ছেড়ে তাঁরা চলে গেলেন। মুনি-ঋষিরা যে সবাই চলে গেছেন, সেই খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিদুর এসে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, "আমরা একটা বড়সড় সমস্যায় পড়তে চলেছি।" ধৃতরাষ্ট্র সন্তানলাভের জন্য এতটাই উতলা ছিলেন যে তিনি বললেন, "ওসব কথা ছাড়ো।" আর যেহেতু তিনি দেখতে পেতেন না, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? সবাই চিৎকার করছে কেন, আর এইসব শব্দগুলোই বা কীসের?”
একশটি পাত্রে, একশত পুত্র
গান্ধারী তখন ব্যাসকে ডাকলেন। একবার ব্যাসমুনি যখন এক দীর্ঘ যাত্রা থেকে ফিরেছিলেন, গান্ধারী তাঁর ক্ষতবিক্ষত পদযুগলের পরিচর্যা করেছিলেন এবং খুব ভালোভাবে তাঁর যত্নআত্তি করেছিলেন, ব্যাসদেব তখন তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, "তুমি যা চাইবে, আমি তোমাকে সেটাই পাইয়ে দেব।” গান্ধারী বলেছিলেন, "আমি শতপুত্র চাই।" তিনি বলেছিলেন, "বেশ, তোমার শতপুত্রই হবে।" এখন গর্ভপাতের পরে তিনি ব্যাসকে ডেকে বললেন, "এটা কী হল? আপনি আমায় শতপুত্রের আশীর্বাদ করেছিলেন কিন্তু তার পরিবর্তে আমি কিনা একটা মাংসপিণ্ড প্রসব করলাম যা আদৌ মানুষের মতো দেখতেই নয় - এটা অন্যরকম একটা কিছু। এটাকে জঙ্গলে ফেলে দিন। কোথাও পুঁতে দিন।”
ব্যাস বললেন, “এখনও পর্যন্ত আমি যা যা বলেছি তার কিছুই কখনও বিফলে যায়নি আর এবারেও যাবে না। ওই পিণ্ডটাকে নিয়ে এসো।” তিনি এটাকে একটা ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারে নিয়ে গেলেন এবং ১০০ খানা মাটির পাত্র, তিলের তেল ও নানারকম গাছ-গাছড়া নিয়ে আসতে বললেন। তিনি এই মাংসপিণ্ডটিকে ১০০টি টুকরো করে সেগুলোকে মাটির পাত্রে রেখে, পাত্রের মুখ বেঁধে দিয়ে, পাত্রগুলোকে ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারে রেখে দিলেন। তখন তিনি লক্ষ্য করলেন যে ছোট্ট একটা টুকরো থেকে গেছে। তিনি বললেন, "আমায় আরেকটা পাত্র এনে দাও। তোমার একশত পুত্র ও একটি কন্যা হবে।” এই ছোট্ট টুকরোটাকে তিনি ওই বাড়তি পাত্রটাতে রেখে তার মুখ বেঁধে ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারেই রেখে দিলেন। আরও এক বছর কেটে গেল। এইজন্যই বলা হয় গান্ধারী দু’বছর ধরে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন - তাঁর গর্ভে এক বছর আর ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারে এক বছর।
সর্প-চোখী পুত্র
এক বছর কেটে যাওয়ার পর প্রথম পাত্রটি ভেঙে তার মধ্যে থেকে সর্প-চোখী বড়োসড়ো এক শিশুপুত্র বেরিয়ে এল। সর্প-চোখী মানে সে চোখের পলক ফেলত না - তার চোখ দুটো ছিল স্থির, সোজাসুজি তাকিয়ে থেকেও যেন কিছুই দেখছে না। আবারও নানারকম সব অমঙ্গল সূচক শব্দ ও অশুভ সংকেত ঘটতে লাগল; যা রাতে ঘটার কথা তা দিনের বেলা ঘটতে থাকল। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র টের পেলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে তাই বিদুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এসব কী হচ্ছে? অশুভ কিছু ঘটেছে। আমার ছেলে কি জন্মে গেছে? দয়া করে আমায় বলো।" বিদুর বললেন, “হ্যাঁ, আপনার একটি পুত্র হয়েছে।" ধীরে ধীরে বাকি সব পাত্রগুলোতেও চিড় ধরল - সবকটি পুত্র বেরিয়ে এল আর একটা পাত্র থেকে ছোট্ট এক শিশুকন্যা বেরিয়ে এলো।
বিদুর বললেন, “আপনার একশত পুত্র ও একটি কন্যা হয়েছে। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি - আপনার প্রথম পুত্রকে মেরে ফেলুন।” ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “কী, আমার প্রথম সন্তানকে তুমি মেরে ফেলতে বলছো? তা কেমন করে হয়?” বিদুর বললেন, “আপনি যদি আপনার প্রথম সন্তানকে মেরে ফেলেন, তাহলে আপনি আপনার নিজের প্রতি, কুরুবংশের প্রতি এবং সমগ্র মনুষ্যজাতির প্রতি অনেক বড়ো উপকার করবেন। আর তারপরেও তো আপনার ১০০ জন সন্তান থাকছে - ৯৯ টি পুত্র এবং একটি কন্যা। এই প্রথম সন্তানটি না থাকলে তারা কোনো অনিষ্ট করবে না। সে সঙ্গে থাকলে তারা সারা পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলবে বলেই আমরা জানি।
অশুভ ইঙ্গিত উপেক্ষা করা হল
গান্ধারী ইতিমধ্যেই তাদের প্রথম সন্তান দুর্যোধনকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তিনি এসব কোনো সংকেতই শুনতে পেলেন না। এসব কোনো অশুভ ইঙ্গিতও টের পেলেন না। গান্ধারী এটা ভেবেই আপ্লুত ছিলেন যে তাঁর প্রথম পুত্র জন্মেছে এবং খুব বড়সড় হয়েছে। তাকে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে তিনি তৎপর হয়ে উঠলেন। বিদুর আবারও বললেন, “জ্ঞানী-গুণীরা সবসময় বলে গেছেন যে পরিবারের ভালোর জন্য একজন ব্যক্তিকে বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে, গ্রামের ভালোর জন্য একটি পরিবারকে, দেশের ভালোর জন্য একটি গ্রামকে বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে। এমনকি অবিনশ্বর আত্মার জন্য গোটা বিশ্বকেও বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে।"
“দাদাভাই, তোমার এই দানবাকার সন্তানটি নরকের তলদেশ থেকে উঠে এসেছে - মনুষ্যজাতির আত্মাকে নীতিভ্রষ্ট ও বিনষ্ট করতে। ওকে এখনই মেরে ফেলো। আমি শপথ করে বলতে পারি, ওর ভাইয়েরা অনিষ্টকারী হবে না আর তুমিও সন্তানসুখ উপভোগ করতে পারবে - ৯৯ জন রাজপুত্র! কিন্তু একে তুমি জীবিত রেখো না।” কিন্তু তাঁর জ্ঞানের চেয়ে নিজের রক্তমাংসের ওপর ধৃতরাষ্ট্রের টান অনেক বেশি ছিল। কাজেই দুর্যোধন তাঁর ১০০ জন ভাইবোনের সাথে হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদে বড় হতে লাগলো, এদিকে পাণ্ডবরা তখন অরণ্যে বেড়ে উঠছেন।
চলবে...
Editor's Note: A version of this article was originally published in Isha Forest Flower, November 2015.