প্রকৃত বন্ধু হয়ে ওঠার উপায়
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, একই জাতীয় পচ্ছন্দ – অপচ্ছন্দ ও সমভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সাধারণ ভিতের উপর দাঁড়িয়েই দু’জন মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সদগুরুর অনন্য বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এমনকি একটি আপেল ও কমলালেবুর মধ্যেও প্রকৃত বন্ধুত্ব তৈরি হতে পারে, যদি তারা অন্যের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজটা করার সাহস রেখেও একে অপরের প্রতি ভালবাসার মধুরতা বজায় রাখতে পারে!
প্রকৃত বন্ধু সর্বদাই সুন্দর হয় না
আগের শীতেই এই ঘটনাটা ঘটেছিল। একটা ছোট্টো পাখি শীতের শুরুর তুষারপাত একটু বেশিই উপভোগ করতে চেয়েছিল। আর সেটা করতে গিয়ে সে শীত এড়াতে সঠিক সময়ে দক্ষিণের দিকে যাত্রা শুরু করতে অপারগ হয়েছিল। দেরিতে ওড়া শুরুর কারণে পাখিটি দ্রুত তুষারে জমে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। একটি গরু ঠিক তার পাশ দিয়ে যাবার সময় অজান্তেই জমে যাওয়া পাখিটার ওপর মলত্যাগ করল। গো-বিষ্ঠার পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে ছোট্টো পাখিটা তাতে ঢেকে গেল। স্তূপাকার বিষ্ঠার উষ্ণতার ছোঁয়ায় তুষার গলে যাওয়ায় পাখিটা এতটাই আরামবোধ করল যে, সেই গো-বিষ্ঠার ভিতরে থেকেই সে আবারও কিচিরমিচির করতে শুরু করল।
সে পথে তখন যাচ্ছিল একটি বিড়াল। পাখিটার আওয়াজ শুনে চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে সে বুঝল যে, ওই গো-বিষ্ঠার ভিতর থেকেই কিচিরমিচির শব্দটা আসছে। বিড়ালটি গো-বিষ্ঠা সরিয়ে পাখিটাকে তার ভিতর থেকে বার করে এনে খেয়ে ফেললো। সুতরাং, কেউ তোমাকে আবর্জনায় চাপা দিয়ে দিল মানেই তাকে তোমার শত্রু ভাবতেই হবে, তা নয়। আর কেউ তোমাকে আবর্জনা থেকে টেনে বার করে আনলো মানেই তাকে তোমার বন্ধু ভাবতেই হবে, তা নয়। সবচেয়ে বড় কথা হল, তুমি যখন আবর্জনায় চাপা পড়ে আছো, তখন কীভাবে মুখ বন্ধ রাখতে হয়, সেটা শেখা উচিত।
প্রকৃত বন্ধু যেটা প্রয়োজন, সেটাই বলে
তুমি যদি কারও বন্ধু হও, তার দোষত্রুটি নিয়ে সবসময় ঘ্যানঘ্যান করার কোনও প্রয়োজন নেই, কিন্তু একইসঙ্গে মানুষের কাছে অপ্রিয় হওয়ার সাহসও যেন তোমার থাকে। সকলের কাছে প্রিয় হয়ে থাকতে গিয়ে, শুধু তোমার চারপাশটুকু প্রীতিকর রাখতে গিয়ে, ভেবে দেখো, কতখানি অপ্রীতিকর অনুভূতির বীজ বুনেছো নিজের ভিতরেই।
তুমি যদি অপ্রীতিকর অনুভূতিতে নিজেকে ভরিয়ে রাখো, যদি অপ্রীতকর অনুভূতির বীজ বপন করো, তার ফলটাও যে অপ্রীতিকর হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সত্যিই তুমি যদি কারও বন্ধু হও, ভালবাসার মধুরতা বজায় রেখেও তার কাছে অপ্রিয় হওয়ার সাহস যেন তোমার থাকে। সাধারণ ভাবে তোমার বন্ধুতা দাঁড়িয়ে থাকে পচ্ছন্দ-অপচ্ছন্দের এক অলিখিত চুক্তির উপর। কিন্তু সত্যিটা হল, এমনকি তোমরা যদি আপেল ও কমলালেবুও হও, তাতেও তোমরা একে অপরের ভালো বন্ধু হতেই পারো। সে-ই তোমার প্রকৃত বন্ধু, ভালবাসার লাবণ্য বজায় রেখেও যে তোমার ভিতরের আবর্জনাকে চিহ্নিত করতে পারে – এটাই হল বন্ধুত্বের মূল কথা।.
https://www.youtube.com/watch?v=lprsSVafYUk
প্রকৃত বন্ধু, অপ্রিয় হওয়ার সাহস
একদা, তিনজন মার্কিন জেনারেল নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন (Grand Canyon) জলপ্রপাত ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে প্রথমজন বাহিনীর সাহস এবং তার প্রতি আনুগত্যের গর্বের আছিলায় বললেন, “আমার বাহিনীর মতো সাহসী এবং অনুগত বাহিনী আর একটাও নেই, ওদের সাহস ও আনুগত্য তুলনারহিত। এর একটা নমুনাও আমি দেখাতে পারি”। একজন সৈন্যকে তিনি গম্ভীর স্বরে তার নাম ধরে ডাকলেন, “প্রাইভেট পিটার!”
দ্রুত হাজির হয়ে প্রাইভেট পিটার বলল, “ইয়েস স্যার!”
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দিকে নির্দেশ করে সৈন্যটিকে সেই জেনারেল বললেন, “আমি এখনই চাই যে, তুমি ওই ক্যানিয়নের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ো”।
সৈন্যটি তখনই তীব্র বেগে দৌড়ে এসে উপর থেকে সেই জলপ্রপাতের মধ্যে ঝঁপিয়ে পড়ল। সে যে কোথায় গিয়ে পড়ল, তা তো বুঝতেই পারছো।
দ্বিতীয় জেনারেল প্রথমজনকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এ তো কিছুই নয়, আমারটা দেখুন”। তার এক সৈন্যের নাম ধরে তিনি ডাকলেন, “ট্রুপার হিগেন্স!”
তখনই ট্রুপার হিগেন্স হাজির হয়ে বলল, “ইয়েস স্যার!”
দ্বিতীয় জেনারেল তার সৈন্যটিকে বললেন, “এটা অত্যন্ত জরুরী, আমি চাই, তুমি এই প্রপাতের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বাকীদের সঙ্গে দেখা করে এসো!”
সৈন্যটি হাত দুটিকে ডানার মতো করে মেলে দিয়ে উড়তে গেলো এবং বুঝতেই পারছো, তারপর কী হল।
তৃতীয় জেনারেল এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। বাকি দুই জেনারেল তার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে বললেন, “কোনও সাহস নেই!”
তৃতীয় জেনারেলের কিছু সৈন্য আশেপাশেই মদ্যপান করছিল। তিনি তাদের একজনকে ডাকলেন এবং দুশো মিটার খাড়া প্রপাতের নীচে খরস্রোতা নদীটিকে দেখিয়ে বললেন, “আমি চাই, এই ক্যানোতে চেপে তুমি ওই নদীটা পার করো”।
সৈন্যটি তার অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, “জেনারেল, মনে হচ্ছে আপনার হুইস্কির পরিমাণটা আবারও বেড়ে গেছে। ওই একেবারে নির্বোধের কাজটা আমি করতে পারবো না”।
তৃতীয় জেনারেল বাকীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখুন, একেই বলে প্রকৃত সাহস”।
তোমার বন্ধুত্বের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামান্য একটু সাহসী হও। তাদের হারাবার জন্যও তুমি প্রস্তুত হয়ে থাকো, কোনও অসুবিধা নেই। যদি তুমি তাদের প্রতি যত্নশীল হও, তাহলে শুধুই নিজের কথা না ভেবে যেটা তাদের জন্য প্রয়োজনীয়, ঠিক সেটাই করো।
শর্তসাপেক্ষে বন্ধুত্ব হয় না
একজন “বিয়ার” প্রেমী ডাক্তারকে আমি চিনতাম। যখন তাকে প্রথম দেখি, তখন সেই বিশাল বপু মানুষটির বয়স প্রায় সত্তর। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি তার এক বন্ধুর কাছে বহু বছর ধরেই নিয়মিত যেতেন, দু’জনে একসঙ্গে “বিয়ার” পানে মজে থাকতেন। সময় পেলেই তারা একসঙ্গে “বিয়ার” নিয়ে আড্ডায় বসতেন। কখনও তিনি যেতেন, কখনও সেই বন্ধুটি আসতো তার কাছে।
হঠাৎই একদিন তার সেই বন্ধুটি কোনও একজন গুরুকে পেয়ে আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন এবং “বিয়ার”-এর নেশাও ত্যাগ করেন। তো সেই ডাক্তার মানুষটি আমাকে পুরো ঘটনাটা বিশদে জানিয়ে বলেন যে, তার বন্ধুটি “বিয়ার”-এর নেশা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের দীর্ঘ বন্ধুত্বেরও চির বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বহু বন্ধুত্বই এভাবে টিঁকে থাকে। যতক্ষণ কিছু বইতে থাকে, ততক্ষণই বন্ধুত্ব থাকে; সেটা চলে গেলেই বন্ধুত্বও শেষ হয়ে যায়।
তোমার যদি কোনও প্রকৃত বন্ধু না থাকে, সত্যিই তুমি জীবনের একটা স্বাদ বঞ্চিত হয়ে আছো। শেষ বিচারে, বন্ধু কে ? যাকে তুমি বন্ধু বলে ভাবছো, সেও তো তোমারই মতো গোলকধাঁধায় পড়ে থাকা এক মানুষ, বন্ধু মানেই তাকে নিখুঁত মানুষ হতে হবে, তা তো নয়। যখন দু’জন মানুষ একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগিয়ে যায়, তখনই তারা পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠে। কোনও সন্দেহ নেই যে, তোমার বন্ধুটিও তোমারই মতো একজন এলোমেলো মানুষ। যখন দু’জন মানুষ একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত আবহ তৈরি করে, তখনই অপর জন তোমার বন্ধু হয়ে ওঠে। একজন কেন, তুমি নিশ্চয়ই অসংখ্য সত্যিকারের বন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছো। কিন্তু তোমার জীবনে এক জনও এমন কেউ যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে তোমার উচিত এখনই নিজেকে নতুন ছাঁচে গড়ে তোলা ।
সম্পাদকের কথা: যে প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ, যদি এমন কোনও বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকে অথবা যদি কোনও আপাত কঠিন প্রশ্ন নিজেকে ক্রমাগত বিব্রত করতে থাকে, সেক্ষেত্রে জীবনের সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সদগুরুকে আপনার প্রশ্ন করুন UnplugWithSadhguru.org.