প্রশ্নকর্তা: হিন্দু সনাতন ধর্মের সঠিক অর্থ কি? এবং এটা কি বর্তমানে শুদ্ধতা হারিয়েছে?

সদগুরু: হিন্দু সনাতন ধর্ম বলে কিছু হয় না। এটা শুধুই সনাতন ধর্ম। সনাতন মানে হ'ল চিরন্তন। যা চিরন্তন তা সবসময়ই সত্যি।

সনাতন ধর্ম হ'ল জীবনের সেই মাত্রা যার কখনও পরিবর্তন হয় না, যা আমাদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। একটি পোকা হোক বা পতঙ্গ, পাখি বা পশু কিংবা কোন গাছ, যাই হোক না কেন, এ সব কিছুই সনাতন ধর্মের দ্বারা চালিত। সেই মৌলিক নীতিসমূহ সমগ্র অস্তিত্বকে পরিচালনা করে। এটা সমাজে কিছু নিয়ন্ত্রণ এবং মানবিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য, মানুষের একে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া কোন ফৌজদারী আইন নয়। কাজ-কর্মের নীতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বদলাতেই হবে। সেটা অন্য ব্যাপার। সনাতন ধর্ম কাজ-কর্মের আইন কানুন নয়। এটা হ'ল অস্তিত্বের ধর্ম।

'হিন্দু' শব্দটি জুড়ে দিয়ে আমরা সনাতন ধর্মের সম্ভাবনা কে সীমিত করে ফেলেছি। হিন্দু একটি ভৌগোলিক পরিচিতি।

'ধর্ম' কথাটির অর্থ আমাদের বুঝতে হবে। ধর্ম মানে হ'ল 'আইন'। ধর্মের অর্থ সাম্প্রদায়িক ধর্মমত নয়। এই সংস্কৃতিতে আমরা সাম্প্রদায়িক ধর্ম বলে কিছু জানি না। আমরা কেবল এটাই দেখছি যে, আপনার জীবনকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবে ঘটানোর পদ্ধতি বা নিয়ম কি কি। আমরা বুঝি যতক্ষণ না আপনি এই নীতিগুলো মেনে চলছেন, আপনার জীবন ঠিকভাবে চলবে না। এই নিয়মগুলো বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া নয়, এগুলো অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। যদি আপনি নিয়মগুলো জানেন এবং সেগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে চলেন, তাহলে আপনার জীবন খুবই মসৃণ হবে। যদি না জানেন, অকারণেই আপনার দুর্ভোগ হবে। 

সনাতন ধর্ম কি হিন্দুদের বা একজন ভারতীয় মানুষের বা অন্য কারোর? সেটা কথা নয়। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, আপনি ভারতীয়, হিন্দু, অ-হিন্দু, যাই হোন না কেন, সনাতন ধর্ম সকলের জন্যই প্রযোজ্য; কারণ এগুলো সেই নীতি যা জীবনের মৌলিক প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে। অন্য কোন সংস্কৃতি এই বিষয়ে এত গভীর ভাবে দৃষ্টিপাত করেনি। সেই গর্বের কারণে আমরা হয়তো বলতে পারি, এটা হিন্দু সনাতন ধর্ম। কিন্তু এর সাথে 'হিন্দু' শব্দটি জুড়ে দিয়ে আমরা সনাতন ধর্মের সম্ভাবনা কে সীমিত করে ফেলেছি। হিন্দু একটি ভৌগোলিক পরিচিতি। হিমালয় এবং ইন্দু সাগরের মাঝখানের যে ভূমি, তা হল হিন্দু। সনাতন ধর্ম প্রত্যেকটি জীবনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এতে বলা হয়েছে - জন্মের পূর্বে, জন্মের পর, বড়ো হওয়ার পর, মৃত্যুর পর, জীবনের বিভিন্ন ধাপে এবং জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে কীভাবে জীবনকে পরিচালিত করা যায়। এটা খুবই সুগভীর ভাবে জীবনকে দেখার একটি পদ্ধতি। 

 

স্মৃতি এবং শ্রুতি

যদি আপনি এখানে একশো বছর আগে আসতেন, আপনি অন্যরকম পোষাক পরতেন এবং অন্য কিছু কাজ করতেন। যদি আপনি হাজার বছর আগে আসতেন, তখন আপনি আরও অন্য কিছু করতেন, হয়তো আপনি একজন কৃষক বা মৎস্যজীবী হতেন। 

আমরা কি কাজ করছি, কিরকম পোষাক পরছি, কিভাবে কথা বলছি এবং কেমন ব্যবহার করছি, তা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ব্যাপার; এটা বদলাতে থাকে। পরের প্রজন্ম কেমন ব্যবহার করবে, কিরকম পোষাক পরবে এবং কি কাজ করবে, এসবই পুরোপুরি আলাদা হবে, এখন আমরা যেভাবে করি তার থেকে। এটা জীবনের এক মাত্রা - একে আমরা বলি স্মৃতি । স্মৃতি কথাটির আক্ষরিক অর্থ হ'ল 'স্মরণ থেকে'। স্মরণের মাধ্যমে যেটা আপনি শিখেছেন, তা হল স্মৃতি। 

আমাদের পিতা-মাতা বা আমাদের সংস্কৃতি যা করেছে, হয় আমরা একই জিনিস করে চলেছি, অথবা প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমরা বিপরীত জিনিস করছি। কিন্তু এটা একটা নিরন্তর পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। কেবলমাত্র এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে নয়, আমাদের নিজের জীবনেও কয়েক বছর পর পর আমাদের স্মৃতি বদলে যাচ্ছে। আমাদের স্মৃতির মাধ্যমে, আমরা জীবনের অনেক দিক বদলে চলেছি। 

আমরা এটা নিয়ে বিতর্ক করতেই পারি যে একশো বছর আগে মানুষ যেভাবে খাবার খেত, আমরা সেভাবে খেতে চাই না, কারণ আমাদের কাজের ধরন পাল্টে গেছে।
 

স্মৃতি হ'ল এমনকিছু যেটা প্রত্যেক প্রজন্মের নতুন করে আবিষ্কার বা সংশোধন করা উচিত। বিবর্তন মানে এই নয় যে আগের প্রজন্ম থেকে উন্নত কিছু করতেই হবে। ব্যাপারটা হল, যেহেতু পরিস্থিতিগুলো বদলে যাচ্ছে, আমরাও সেই পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে বিবর্তিত হচ্ছি। পরিস্থিতিগত কাজকর্মের পরিবর্তন সবসময় হবেই, এবং বিবর্তনও। আমরা এটা নিয়ে বিতর্ক করতেই পারি যে একশো বছর আগে মানুষ যেভাবে খাবার খেত, আমরা সেভাবে খেতে চাই না, কারণ আমাদের কাজের ধরন পাল্টে গেছে। যখন আপনি জমিতে লাঙ্গল দিতেন, আপনি কি খেতেন, কতখানি খেতেন সেটা অন্য রকম ছিল। আপনি কিভাবে কি করবেন তা সবসময়ই বদলাতে হয়। এমনকি সংবিধানেও কিছু মৌলিক অধিকার আছে যা একেবারেই অলঙ্ঘ্য। আপনি সেগুলো কোনোভাবেই বদলাতে পারবেন না। বাকি সব কিছুই সংশোধন করা যাবে, উন্নতিসাধন করা যাবে এবং বাতিলও করা যাবে। 

আপনার স্মৃতি এবং আমার স্মৃতি পৃথক হতে পারে। কিন্তু আরও একটা কিছু আছে, যাকে বলা হয় শ্রুতি। এটা নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে; এর একটা দিক হলো- এটাই জীবনের সুর। এই সুর আপনি ঠিক করে দেন নি – এটাই হ’ল সৃষ্টি। 

যদি আপনি জীবনের শ্রুতি উপলব্ধি করতে পারেন, তবেই আপনি ছন্দ খুঁজে পাবেন। 'ভারত' কথাটির অর্থ এটাই। 'ভা'-এর অর্থ হ'ল ভাব বা জীবনের অভিজ্ঞতা। 'রা'-এর অর্থ হ'ল রাগ, যেটা জীবনের শ্রুতি। 'তা' এর অর্থ হ'ল তাল, বা ছন্দ। ভাব হ'ল আপনার ভেতরে যা ঘটছে। এটা একটা অভিজ্ঞতা। কিন্তু রাগ এবং শ্রুতি আগে থেকেই ঠিক করা আছে। এবার সঠিক ছন্দটা খুঁজে বের করা আপনার কাজ, যাতে করে জীবনটা সুন্দর হয়ে ওঠে - এক অপূর্ব সুন্দর সঙ্গীতের মতো। যদি আপনি ছন্দ খুঁজে না পান, এই একই শ্রুতি যা জীবনকে সহজ করে দেয়, সেটাই আপনাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে। 

শ্রুতির কোন পরিবর্তন হয় না, কারণ এটি আপনার দ্বারা ঠিক করা নয় - এটি সৃষ্টির ঠিক করা। সুতরাং সনাতন ধর্মের অর্থ হ'ল এটা বোঝা যে আপনার জীবন কিসের দ্বারা চালিত হচ্ছে, যাতে করে আপনার জীবন আপনি সুগভীর ও সুন্দর করে বাঁচতে পারেন। 

নীতিগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা

এই সংস্কৃতিতে নীতিবাক্য, অনুশাসন, আপনার কি করা উচিত, কি করা উচিত নয়, এটা করলে তুমি স্বর্গে যাবে, ওটা করলে তুমি নরকে যাবে, এসবের কথা কেউ বলে না। এখানে এসব নেই তার কারণ, আমরা এই মাত্রাটি মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছি যে যদি আপনি এই নীতিগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন, আপনার শাস্তি বা পুরস্কার কোনটারই প্রয়োজন হবে না। এটা ঠিক এরকম যে যদি আপনি ট্রাফিক নিয়ম বুঝতে পারেন এবং সেইমত গাড়ি চালান, আপনার কোন পুলিশ কর্মীর প্রয়োজন নেই। 

বর্তমানে বলা হচ্ছে এই পৃথিবীতে এক লক্ষ কোটিরও বেশি জীব রয়েছে, কিন্তু আমার মনে হয় তার থেকেও অনেক বেশী রয়েছে, যা আপনারা কখনও দেখেনই নি। একটি অনুবীক্ষণিক জীব থেকে মানুষ পর্যন্ত এবং তার মধ্যবর্তী সমস্তকিছু, এগুলো সবই একই মাটি থেকে এসেছে। একই মাটি থেকে একটি গাছ অথবা একটি লতা বড়ো হচ্ছে। একই মাটি থেকে আপনি খাদ্য খেয়েছেন এবং আপনার এই ধরনের শরীর হয়েছে। সেই একই মাটি থেকে আমি খেয়েছি, এবং আমার এই ধরনের শরীর হয়েছে। 

প্রশ্ন একটাই, আপনি কত দ্রুত বা কতদূর যাবেন? কতখানি গভীর ভাবে আমরা এই নীতি উপলব্ধি করছি এবং এর সাথে কতটা তাল মিলিয়ে আমরা চলছি?

আপনি যাই করুন না কেন আপনি একটা গাছ, বা কুকুর, বেড়াল, গরু, হাতি কিংবা বাঘ হতে পারবেন না। উৎস কিন্তু একটাই, অথচ এর বিভিন্ন প্রকাশ দেখুন। সুতরাং স্পষ্টতই কোন এক নীতি এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে, সে যাই ঘটুক না কেন। এটা রেল লাইনের মতো, সুনির্দিষ্ট ভাবে, স্থির করা আছে এবং আপনি এর উপর দিয়ে চলেছেন। প্রশ্ন একটাই, আপনি কত দ্রুত বা কতদূর যাবেন? কতখানি গভীর ভাবে আমরা এই নীতি উপলব্ধি করছি এবং এর সাথে কতটা তাল মিলিয়ে আমরা চলছি? 

কার্যত, যোগের পুরো ব্যবস্থাটাই হল বাকি সমস্ত অস্তিত্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, যাতে করে আপনার জীবন আনন্দময় ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত হয়। আপনার জীবনে কেবল একটাই ভুল হতে পারে - আপনি আপনার জীবনের পূর্ণ বিকাশ করতে পেরেছেন কি না? একটি গাছের জীবনে কি ভুল হতে পারে? একমাত্র যেটা হতে পারে সেটা হল, গাছটি তার পূর্ণ ক্ষমতায় বিকশিত হবে, নাকি অর্ধ-বিকশিত অবস্থায় মারা যাবে? মানুষের ক্ষেত্রেও এটাই সত্য। যদি আপনি নিয়মগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন, আপনি আপনার পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত হবেন। যদি তা না হয়, আপনি কোনোভাবে অবরুদ্ধ হয়ে থাকবেন। মূলত, এটাই আমাদের একমাত্র চিন্তা, যদিও মানুষ এ ব্যাপারে সচেতন নন। তাদের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা, উচ্চাশা এবং আকর্ষণ, এ সবই এক পরিপূর্ণ জীবন হওয়ার জন্য। যদি আপনি একটি পরিপূর্ণ জীবন হতে চান, সেই নীতিগুলো উপলব্ধি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যার উপর ভিত্তি করে এই জীবন ঘটছে। 

সনাতন ধর্ম আপনার বা আমার নয় - এটা সৃষ্টির দ্বারা স্থাপন করা। আপনার, আমার কাজ হ'ল এর সাথে তাল মিলিয়ে চলা। এই ভারতবর্ষে আমরা এটা উপলব্ধি করেছি এবং বিশেষ ভাবে একত্রিত করে লিপিবদ্ধ করেছি। তার মানে এই নয় যে, বাকি দুনিয়াতে আর কেউ এ ব্যাপারে জানেন না। অনেক মানুষই এটা জানেন। তাঁরা হয়তো শ্রুতি ও স্মৃতি হিসেবে এগুলোকে লিখে যান নি। কিন্তু গোটা পৃথিবী জুড়ে অনেক মানুষই এর সাথে তাল মিলিয়ে চলেছেন, সব জায়গাতেই মানুষ বিকশিত হয়েছেন এবং সুন্দর ভাবে বেঁচেছেন। 

তো, সনাতন ধর্ম কি আজ তার শুদ্ধতা হারিয়েছে? এটা আমাদের হাতেই নেই যে আমরা এর শুদ্ধতা নষ্ট করতে পারব। ব্যক্তি বিশেষে, উপলব্ধি হয়তো শুদ্ধতা হারিয়েছে। বিভিন্ন মানুষ হয়ত একে বিভিন্ন মাত্রায় উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু সনাতন ধর্মের শুদ্ধতা নষ্ট করা যায় না, কারণ এটি অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। আপনি এটা অশুদ্ধ করতে পারেন না, কারণ আপনি এটা সৃষ্টি করেননি।