শরীর সবকিছু মনে রাখে
সদগুরু ব্যাখ্যা করছেন যে আজকাল উৎকণ্ঠা, নিরাপত্তাহীনতা এবং অবসাদের বাড়ন্ত মাত্রা আমরা যে সর্বত্র দেখতে পাই, তার অন্যতম কারণ হল আমাদের শরীর বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে।
আজ,আমরা এমন একটি সংস্কৃতির মধ্যে বাস করছি যেখানে সারা জীবন এক সঙ্গীর সঙ্গেই কাটাতে হবে এমনটি আর আবশ্যিক নয়। সময় বদলেছে। আজ একজন সঙ্গী একটি ‘এক্সপাইরি ডেট’, বা সমাপ্তির তারিখ, সঙ্গে নিয়ে আসেন। যখন আপনি সম্পর্কটি গড়েন, তখন ভাবেন তা চিরকালের জন্যে। কিন্তু তিন মাস যেতে না যেতেই আপনি ভাবেন, “হে ভগবান! আমি কী করে এই মানুষটির সঙ্গে আছি”? এরকমটা এই জন্যই হচ্ছে কারণ আপনি সবকিছুই আপনার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা অনুযায়ী করছেন। যার ফলে, আপনি কোন কিছুতেই স্থির থাকেন না – আজ আছেন, কাল নেই, এভাবেই চলতে থাকেন। তাই শরীর যখন অস্থির হয়ে ওঠে বা ভেঙে পড়ে, তখন আপনি অসম্ভব যন্ত্রণা ও কষ্ট পান। যদি আপনি এরকম বার বার প্রেমে পড়তে থাকেন আর তার থেকে বেরোতে থাকেন, যদি বার বার বিভিন্ন মানুষের সাথে এ ধরণের সম্পর্ক তৈরি করতে থাকেন, তাহলে এক সময়ে গিয়ে আপনি অনুভূতিহীন হয়ে পড়বেন, তখন আর কাউকেই পছন্দ হবে না। এর কারণ,ঋণানুবন্ধ ।
ঋণানুবন্ধ হল কর্মের একটি নির্দিষ্ট দিক - কর্মের উপাদানের এটি একটি নির্দিষ্ট কাঠামো। মানুষের মধ্যে মেলামেশা ও দেখাসাক্ষাতের ফলে এটা ঘটে। যেখানেই দেখাসাক্ষাৎ এবং মেলামেশা ঘটে সেখানেই ঋণানুবন্ধের সৃষ্টি হয়। বিশেষত যখন দুটি দেহের মিলন ঘটে, তখন ঋণানুবন্ধ খুব গভীর হয়। এটি দেহের মধ্যে চলতে থাকা এক ধরণের ‘রেকর্ডিং’ – যা যা ঘটছে শরীর তা সব কিছু নথিভুক্ত করে চলেছে। অন্য কোনো শরীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলে, সেই শরীরের প্রানশক্তিকে আপনার শরীর লিপিবদ্ধ করে রাখে।
যেহেতু শরীর সবকিছু মনে রাখে, তাই, একাধিক সঙ্গী থাকলে, একটা সময়ের পরে শরীর বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এবং এই বিভ্রান্তি আপনার জীবনে অজস্র বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পায়। বিভ্রান্ত মন নিয়ে কোনোভাবে জীবন যাপন করা যায়। কিন্তু আপনার শরীর যদি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তাহলে আপনি গভীর সমস্যায় পড়বেন।
অনেক ভাবেই, আজকে আমাদের আশেপাশে যে উদ্বেগ, নিরাপত্তাহীনতা এবং অবসাদের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে তার কারণ এটাই যে আমাদের শরীর বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। একটা সময়ের পর, মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জন্য আলদা করে কারণ লাগে না। লোকে এমনিই উন্মাদ হয়ে পড়েন, কেবল তাদের শরীর বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে বলে।
দেহ একাধিক অন্তরঙ্গতায় বিভ্রান্ত হয়। আর একটি বিষয় হল, আপনি কী ধরনের খাদ্য গ্রহণ করেন। যখনই সামান্য সমৃদ্ধি আসে, মানুষ ভাবতে থাকে তাঁকে একটি ভোজনেই সব ধরণের খাবার খেতে হবে। ভারতবর্ষে প্রাচীণপন্থী মানুষজন খাবারের পাতে দুটি থেকে তিনটির বেশি পদ খান না, এবং ওই পদগুলি সব সময় একে অপরের সহকারী, কখনই পরস্পরবিরোধী খাবার নয়। লোকেরা বুঝতেন যে আমাদের বাড়ির রান্নাই আমাদের শরীর ভালো রাখে, তাঁরা যখন কোনও একটি বিশেষ সব্জি রান্না করতেন, তাঁরা জানতেন যে তাঁরা একটি বিশেষ তরকারীই রান্না করছেন। যখন তাঁরা ওই বিশেষ সব্জি দিয়ে পদ রান্না করতেন তখন তাঁরা প্রথাগতভাবেই অন্য নির্দিষ্ট কিছু পদ তৈরি করতেন না, কারণ তাঁরা বুঝতেন যদি তাঁরা সেই খাবারগুলো মেশান তাতে শরীর বিভ্রান্ত হয়ে যাবে।
আমাদের ছোটবেলায়, আমাদের শেখানো হয়েছিল কেমন করে বাজার থেকে সব্জি কিনতে হবে। এই ব্যাপারগুলো এখন পুরোপুরি হারিয়ে গেছে, কিন্তু আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাকে শেখানো হয়েছিল যখন আমি বাজারে যাব, “যদি তুমি এই সব্জিটা কেনো, তাহলে তুমি ওটা কিনবে না, কারণ দুদিনের মধ্যে ওই দুটো সব্জি একসাথে খাওয়া যাবে না। যদি তুমি এটা খাও, তাহলে তুমি ওটা খেতে পারবে না”, কারণ তাহলেই তোমার শরীর সব গুলিয়ে ফেলবে। আর একবার যদি তোমার শরীর বিভ্রান্ত হয়ে যায় তুমি দিশাহীনভাবে ঘুরে বেড়াবে। এই বোধটা আমাদের সবসময় ছিল।
আমি যা দেখি আজকাল, আপনি যদি কোনও সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তির নৈশভোজে আমন্ত্রিত হন, সেটা উন্মাদনার পর্যায়ে পৌঁছয়। সম্প্রতি এমনই এক অনুষ্ঠানে এক ব্যক্তি গৌরবের সঙ্গে ঘোষণা করলেন যে তাঁদের খাদ্য তালিকায় ২৭০ রকমের ভিন্ন ভিন্ন পদ রয়েছে। লোকে সব কটা পদের একটু একটু করে নিয়ে খান। এই ধরনের খাদ্যে শরীর স্বাভাবিক ভাবেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
সুতরাং এই দুটিই হল প্রধান সমস্যা – লোকজন ঠিকভাবে খাদ্য গ্রহণ করেন না এবং অন্য শরীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে বাছ বিচারের বোধ রাখেন না, যা শরীরে বিভ্রান্তি বোধ সৃষ্টি করে, যার ফলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর শরীর মূল্য চোকাতে বাধ্য হয়। “তাহলে আমি কি পাপ করেছি? এটা কি আমার কাছে তারই শাস্তি?” ব্যাপারটা তা নয়। প্রতিটি কার্যের একটি পরিণাম রয়েছে। এটি কোনও মূল্যবোধ থেকে বলছি না; এটি জীবন-প্রক্রিয়ার এক অংশ। মনের সঙ্গে যেমন কার্য করবেন, তার সেরকম পরিণতি হবে। দেহের সঙ্গে যেরকম কার্য করবেন, তার সেরকম পরিণতি হবে।
এই বিষয়গুলোকে গভীরভাবে বোঝা হয়েছিল এবং তার ওপর ভিত্তি করে জীবনকে একটি নির্দিষ্ট উপায়ে গঠন করা হয়েছিল। এখন, স্বাধীনতার নাম করে আমরা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছি। এর ফলে বহু যন্ত্রণা ও কষ্ট পাচ্ছি। হয়ত আরও কিছু শতাব্দী পর আমরা বুঝতে পারব এটি বেঁচে থাকার সঠিক উপায় নয়।