স্বামী নির্বিচার : এটা আবার একটা সোমবার, আমার ছুটির দিন। আবার আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে চিন্তা ও আবেগের জাল বুনে যাচ্ছিলাম- জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছে তা বোঝার চেষ্টা করছিলাম । আবারও আমার কাছে কোন উত্তর ছিল না। আমার এখনও মনে আছে এটা ১৯৯০ এর কথা, এবং জীবনটা ভালই কাটছিল এমনিতে - খাবার, সিনেমা, অ্যাডভেঞ্চার এসব নিয়ে। কিন্তু আমার ভেতরে একটা অসহ্য রকমের অসন্তুষ্টি ছিল এবং নিজেকে পরিপূর্ণ করার জন্য আমি নানারকম উদ্ভট কাজকর্ম করে বেড়াতাম। একদিন কোন কারণ ছাড়াই চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু চাকরি ছাড়ার পর ও আমার জীবনে সেরকম কোন পরিবর্তন এলো না। এর পরেও দুটো চাকরি করলাম, বাবার সঙ্গে কয়েকবার বেশ জোরদার ঝগড়া হল এবং ভীষণ ভাবে মানসিক টানা- পোড়েন ভোগ করার পর অবশেষে ১৯৯৪ এর এপ্রিলে আমার মা জোর করেই আমাকে ঈশা -যোগা ক্লাসে যোগদান করালেন। এবং তারপর থেকে সবকিছু স্থায়ীত্ত পেতে লাগলো বা কোনকিছুই আর স্থির থাকল না - তবে সেটা ভালোর জন্য।

ক্লাস শেষ হওয়ার পর থেকেই তামিলনাড়ুতে তখন যে সমস্ত ঈশার ক্লাস হ'ত, সেগুলোতে প্রত্যেক রবিবার আমি ভলেন্টিয়ারিং করতে শুরু করলাম। নব্বই দিনের যে ' হোলনেস ' প্রোগ্রাম হয়েছিল,তাতেও আমি ভলেন্টিয়ার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল এক সপ্তাহ থাকার, কিন্তু প্রায় পুরো প্রোগ্রাম এর সময়টাই থেকে গেছিলাম। সেই সময় সদগুরুর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার যে প্রকাশ দেখেছিলাম - একজন সাধারণ মানুষকে নির্বিকল্প সমাধিতে পৌছাতে ( সমাধির উচ্চতম অবস্থা, মহাসমাধির আগে) দেখা, গভীর ধ্যানাবস্থা এবং সমান ভাবে আশ্রমের তীব্র নির্জনতার মূহুর্ত গুলো - এসব আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম মূহুর্ত গুলোর মধ্যে অন্যতম।

' হোলনেস ' প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর, আশ্রম থেকে ফেরার সময় রয়ে গেল এক তীব্র ইচ্ছে সদগুরুর কাছেকাছি থাকবার। ১৯৯৪ এর ডিসেম্বরে আমি শুনলাম যে সদগুরু, যারা ব্রহ্মচর্য নিতে আগ্রহী তাদের আবেদন পত্র জমা দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তখন আমি এই পথের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না কিন্তু সদগুরুর কাছাকাছি থাকতে পারব, এই ভেবে আমি এর জন্য আবেদন করলাম। ১৯৯৫ এর ফেব্রুয়ারী, মহাশিবরাত্রির দিন অন্য আরও সাতজনের সঙ্গে আমার দীক্ষা হল - ঈশার মহান ব্রহ্মচর্য পরম্পরা শুরু হলো ।

কঠোর পরিশ্রমের সাথে মজার দিনগুলি

আশ্রমের নতুন জীবন ধারার সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমার কোন অসুবিধে হল না - সে আমরা যতই সাধারণ ভাবে থাকি না কেন সেই দিনগুলো ছিল চরম আনন্দের। আমরা মাত্র কয়েকজন, পাত্তির অসাধারণ রান্না, কোন নির্দিষ্ট কাজ নেই, নদীতে প্রত্যেক দিন কাদার- স্নান ( মাড- বাথ ), জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, পুকুরে সাঁতার কাটা, রবিবার ক্রিকেট খেলা, ফুল গাছ এবং অন্য সব গাছে জল দেওয়া, অন্যদের সাথে ‘ইগলু’ ( সাধনার জন্য তৈরী একটি স্থান ) তৈরি করা, সাধনা করা এবং মাঝে মাঝে আশ্রমে দর্শনার্থীদের আগমন - জীবন ছিল অসাধারণ এবং সহজগতি..

তারপর ১৯৯৫ এর মে মাসে আশ্রমে প্রথম বারের জন্য ' সম্যমা ' প্রোগ্রাম হল এবং তার পর থেকেই ধ্যানলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার কাজ বেশ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো। ধীরে ধীরে আশ্রম আরো সুসংগঠিত হতে শুরু করলো - যদিও তা আজকে আমরা যা দেখছি, তার মাত্রা বা সুযোগের তুলনায় কিছুই নয়। আমার যে সব কাজের দায়িত্ব ছিল তা হলো - তিন মাসের জন্য সাথুমাভু (সঞ্জীবনী) কাঞ্জী তৈরী করা, তার সাথে বৈদ্যুতিক কাজকর্ম দেখাশোনা করা, জলের পাইপ সংক্রান্ত কাজ এবং প্রোগ্রাম এর সময় মেঝের যাবতীয় ব্যবস্থা করা; এসবই কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা বা ট্রেনিং ছাড়াই।

সেই সময় আমাদের আর একটি কাজ ছিল, যে সব লরি এবং ট্রাক ধ্যান লিঙ্গের নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে আসত, সেগুলোতে সাহায্য করা। থানীরপান্ধাল থেকে আশ্রম পর্যন্ত, পঙ্কিল, কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে এই লরি গুলোকে আমাদের ঠেলতে হত। যখন আমরা লরি গুলোকে ঠেলতাম, লরির সাহায্যকারী লোকেরা ট্রাক থেকে নেমে পড়ত কিন্তু অনেক সময় তারা আমাদের পিছন পিছন ঐ কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে হেটে আসতে অস্বীকার করত। কাজেই আশ্রমে পৌঁছনোর পর আমাদেরই সেই সব মালপত্র নামাতে হত। একটি ঘটনার কথা আমার খুব মনে আছে, যখন আমরা তিনজনে এক লরি ভর্তি কাডাপা- স্টোন নামিয়েছিলাম, যার প্রত্যেকটার ওজন ছিল দশ কেজি করে।

আর একবার, আমাদের জন্যে সিমেন্ট বস্তা বোঝাই করা একটি ট্রাকের সঙ্গে যে সমস্ত হেল্পার এসেছিল, প্রতিটি বস্তা নামানোর জন্য দু' টাকা করে চেয়ে বসল। আমরা ১.৭৫ টা. পর্যন্ত দিতে রাজী ছিলাম কিন্তু তারা কিছুতেই মানলো না। ওরা ভেবেছিল, এই প্রত্যন্ত জায়গায় আমাদের কোন বিকল্প নেই। ওরা আমাদের ভালো করে চিনত না; অন্য দু'জন ব্রহ্মচারীর সাথে আমি এবং ধানিকান্ডির থেকে আর একজন শ্রমিক মিলে ২০০টা বস্তা নিজেরাই নামিয়ে ফেললাম - তারা আবাক হয়ে গেল, আর আমরাও।

লিঙ্গের ফাটল

dhyanalinga-consecration-sadhguru-sitting-front-of-linga

এটা প্রায় ১৯৯৬ এর জুন মাস হবে, যখন ধ্যান লিঙ্গের স্টোনটি/পাথরটি আশ্রমে এসে পৌঁছল। তার দু- এক মাস পর একদিন রাতে আশ্রমের সকল অধিবাসীদের লিঙ্গের চারপাশে জড় হতে বলা হল, সদগুরুর সঙ্গে একটি প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে। বালি বিছিয়ে তার উপর লিঙ্গটি সমান্তরাল ভাবে শুইয়ে রাখা ছিল উপরের সহস্রার অংশটি দক্ষিণমুখী করে। সদগুরু লিঙ্গটিতে বিভূতি মাখালেন এবং সহস্রারের চারপাশে বিভূতি দিয়ে একটি বড়ো বৃত্ত তৈরী করলেন। আমরা চোখ বন্ধ করে ' ওঁম নমহ্ শিবায়ঃ ' মন্ত্রোচ্চারণ করছিলাম। কোন এক সময় সদগুরু একটি তালি দিলেন, যেমন তিনি সাধারণত দিয়ে থাকেন আমাদের এনার্জি বাড়ানোর জন্য।

পরের দিন সকালে যখন আমি লিঙ্গের কাছে গেলাম, আমি লক্ষ্য করলাম - আগের রাতে সদগুরু বিভূতি দিয়ে যে বৃত্ত টা বানিয়েছিলেন, সেটা ভেদ করে একটি লাইন চলে গেছে। আরও কাছে গিয়ে দেখলাম লাইন টা উভয় দিকেই বিস্তৃত হয়েছে এবং এটা লিঙ্গের মধ্যে চুলের মত সরু ফাটল হতে পারে। আমরা সদগুরু কে জানালাম এবং তিনি তৎক্ষণাৎ আমার সঙ্গে এলেন এটা পরীক্ষা করার জন্য। তারপর তিনি শ্রীনিবাসন দাদা কে বললেন সরবরাহ কারীদের জানাতে, তারা যেন এই ফাটলটি আরও ভালো করে পরীক্ষা করার জন্য কাউকে পাঠান। দু'দিন পর চেন্নাই থেকে কয়েকজন দক্ষ ব্যক্তি এলেন এবং নিশ্চিত করলেন যে এই সরু ফাটলটি আর বাড়বে না বা স্টোন টিকে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। তারা চলে যাবার পর সদগুরু আমাদের লিঙ্গটিকে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে বললেন। কয়েকদিন পর আমরা লিঙ্গের উপর একটি খড়ের চালা বানিয়ে দিলাম।

ধ্যানলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার দু'বছর পর একটি সৎসঙ্গে সদগুরু ঐ ফাটলের কথা প্রথম বললেন। তিনি বললেন যে প্রতিষ্ঠার সময় যাতে লিঙ্গটি ফেটে না যায়, সেটা রোধ করতেই তিনি একটি প্রক্রিয়ার সময়,, তালি দিয়ে প্রাথমিক অবস্থাতেই লিঙ্গে এই ফাটলটি সৃষ্টি করেছিলেন। পরে যখন লিঙ্গটিকে দাঁড় করানো হ'ল, ফাটা দিকটি লিঙ্গের পিছনে রাখা হল। এখনও সেটা সে জায়গায়ই আছে।

পরিব্রাজন

এটা ছিল ২৪ শে সেপ্টেম্বর,২০০১, সন্ধ্যে ৭- টা, আমাকে সদগুরুর সাথে মন্ডপে দেখা করতে বলা হল। আমি জানতাম এর মানে কি হতে পারে, এবং ঠিক তাই ; যেইমাত্র আমি ঢুকলাম, সদগুরু আমাকে তাঁর একটি ব্যবহৃত লম্বা শাল দিলেন, আর একটি কাগজ, তাতে লেখা," এক বছর। বারানসী ও কেদার ।" পরের দিন ভোর ৫:৪০য়ে আমি ত্রিকোণ ব্লক ছেড়ে বেরিয়ে এলাম এবং দেখলাম মা গম্ভীরী ও স্বামী নিসর্গ একটি ব্যাগ নিয়ে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাগে ছিলো একটি উলের চাদর, একটি ভিক্ষাপাত্র এবং প্রথম ভিক্ষা - আমার পরের বারের খাবার। সদগুরু আমাকে যে শালটি দিয়েছিলেন, সেটিকে আমি তিন টুকরো করলাম - একটি অংশ তোয়ালে হিসেবে ব্যবহার করতাম, অন্যটি ধুতি হিসেবে এবং আর একটি কৌপিন হিসেবে। আমি আবার ও একবার পরিব্রাজকের সাধনার জন্য বেরিয়ে পড়লাম।তার আগের বছর ডিসেম্বরে সদগুরু আমাকে এক মাসের জন্য এই সাধনায় পাঠিয়েছিলেন।

ধ্যান লিঙ্গের দর্শন করে বেরিয়ে পড়লাম। এক মূহুর্তের জন্য ভীষণ কষ্ট হল, দীর্ঘ এক বছরের জন্য আশ্রম ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে। আশ্রমের বাইরে পা রাখতেই আমি ফুঁপিয়ে উঠলাম। পর মূহুর্তেই আবেগ সরে গিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে এলো - আমি কি করবো? কি খাব? কোথায় ঘুমাবো? কোথায় যাব? একটা দিন এই চিন্তা আমায় আচ্ছন্ন করে রাখল। আমি জানতাম, সাধনা শেষ না করে আমি আশ্রমে ফিরতে পারব না। কাজেই উদ্দেশ্য হীন ভাবে আমি দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ালাম। আমি সবরকম ভুখন্ডের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেছি, সমস্ত রকমের মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, যা দেওয়া হয়েছে তাই খেয়েছি, এবং বিভিন্ন রকমের সমস্যা ও যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে গেছি। এমনকি আশ্রমে ফিরে আসার পরেও জীবন আর আগের মত থাকে নি।

আমি প্রথমে গেলাম বারানসী এবং সেখান থেকে ভোপালের কাছে ভোজপুর লিঙ্গ দর্শন করলাম। সেখানে আমার ধুতি ছিঁড়ে গেল আর যে জায়গায় আমি এটা সেলাই করতে নিয়ে গেলাম, দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের একটা পোস্টার দেখতে পেলাম। আমি দেখে খুব খুশি হলাম যে একটি খুব কাছেই আছে। সুতরাং আমি উজ্জ্বয়নে মহাকাল দর্শন করলাম। আমি এক জ্যোতির্লিঙ্গ থেকে অন্য জ্যোতির্লিঙ্গে গেলাম এবং গ্রীষ্মকালে কেদার। এমনকি ছোট বেলার তাজমহল দেখার ইচ্ছে পূরণ করতে আমি আগ্রাতেও গেলাম। আমি বাস্তবিক একজন পরিব্রাজক সাধুর জীবন কেমন হয়,তার স্বাদ্ পেলাম। কয়েকটি ঘটনা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে...

যখন গুরুপূজা মনে আসছিল না

একদিন সকালে হিমালয়ে যখন আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম, কোনও কারণে গুরুপূজার পুরো মন্ত্রটা আমি বলতে পারছিলাম না। প্রত্যেকবার যতই মনের জোর নিয়ে আমি চেষ্টা করি না কেন, কয়েকটা লাইনের পর থেমে যাচ্ছিলাম। " যেই দিন গুরুপূজা আমার মধ্যে প্রবাহিত হছে না, এর চেয়ে ভালো উপত্যকায় ঝাঁপ দিয়ে দেওয়া, " আমি মনস্থির করলাম এবং ঝাঁপ দেওয়ার জন্য রাস্তার কিনারার দিকে হাঁটতে লাগলাম। তৎক্ষণাৎ গুরুপূজার লাইন গুলো আমার মনে এসে গেল, বিনা চেষ্টাতেই এটা আমার মধ্যে ঘটে গেল। সেই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম যে এই এক বছর সদগুরু সবসময় আমার ভেতরে এবং আমার চারপাশে ছিলেন।

যখন একটি অদৃশ্য হাতের সাহায্য এল

আমি হেমকুন্ড সাহিব যাচ্ছিলাম। পায়ে চলার রাস্তাটা ছিল বরফে ঢাকা এবং মাত্র দেড় ফুট চওড়া, আর তীর্থযাত্রী এবং কুলি উভয়ে একই রাস্তা দিয়ে যেত। আমি পাহাড়ে উঠছিলাম। হঠাৎ করে তাড়াহুড়ো করে এরএকজন নেমে এলো। আমি রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে উপত্যকার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সে যেমনি আমাকে পাশ কাটাল, আমার পা কিনারা থেকে পিছলে গেল। সেই মূহূর্তে আমি দেখলাম উপত্যকাটা বাস্তবিক কতখানি গভীর ছিল। পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় ছিল না, কিন্তু পড়লাম না। ঠিক যেন একটা হাত আমাকে আটকে দিল। কিভাবে? আমি জানি না।

যখন আপনার চলার পথে লোকে পাথর ছোঁড়ে

হায়দ্রাবাদ পৌঁছনোর ঠিক আগে, প্রায় দশ কিলোমিটার বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে, আমি বাড়াবাড়ি রকম সর্দি আর জ্বরে পড়লাম। তখন দশেরার সময়, শহরে উৎসব চলছে। যখন আমি হুসেন সাগর হ্রদ পার করছিলাম, কয়েকজন ছেলে আমাকে ব্যঙ্গ- বিদ্রুপ করে অনুসরণ করতে লাগলো। যার ফলে আমি ঘুমোনোর জন্য কোন জায়গা পেলাম না; অবশেষে ভোর চারটের সময় সেকেন্দ্রাবাদের একটি দোকানের সিঁড়িতে দু'ঘণ্টার জন্য ঘুমোলাম। সকাল সাতটার সময় আমার ক্রিয়া করার জন্য একটা জায়গা খুঁজে নিলাম। যেইমাত্র আমি শুরু করলাম, একজন মাতাল তার পকেট থেকে মদ বার করে আমাকে খাওয়ানোর জন্য জোরাজুরি করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আমি আর সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে লাগলাম।আবার সেখান থেকে উঠে গিয়ে অন্য জায়গা খুঁজতে গেলাম।

যখন আপনার কাছে সাহায্য আসে

যখন আমি আদিলাবাদ পেরোচ্ছিলাম, আমার গলায় খুব বেশী হাঁপানি জনিত সাঁই সাঁই শব্দ হচ্ছিল। ভাগ্যক্রমে একজন ডাক্তার পেলাম যিনি আমাকে বিনা পারিশ্রমিকে চিকিৎসা করলেন এবং রাতের জন্য বিস্কুট খেতে দিলেন। মানুষের সহৃদয়তার জন্য আমার পকেটে সবসময়ই বিস্কিট থাকতো। একবার সারাদিন আমি কেবল আধা- বোতল জল খেয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার এর বেশি হেঁটেছিলাম। কিন্তু ঐ পুরো একটা বছরে মাত্র তিন দিনই এমন ছিল যখন আমি খাবার পাই নি। আমার যখনই প্রয়োজন হ'ত, কেউ না কেউ আমাকে শাল বা সোয়েটার বা কম্বল দিত। বিশেষ করে মুসলিমরা খুব উদার ভাবে আমাকে খাবার দিয়েছে, যখনই আমাকে তারা ক্ষুধার্ত দেখতে পেতো।

যখন খিদের যন্ত্রণা ঘনিয়ে আসে

একবার আমি, খিদের যন্ত্রণা চাক্ষুষ করেছিলাম, তবে সেটা আমার খিদে নয়। এটা বোধহয়ে রাজস্থানে ঘটেছিল। একটা লোক আমার দিকেই আসছিল রাস্তা দিয়ে । দেখে মনে হচ্ছিল সে রাস্তার পাশে খাবার খুজছিল। আমার থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে দেখলাম সে হাঁটু মুড়ে বসে খাওয়ার জন্য কিছু তুলছে। দূর থেকে মনে হচ্ছিল এক কাদার জমি , আর আমি ভাবছিলাম ওখানে সে কি খুঁজে পাবে!

ভালো করে দেখার জন্য আমি কাছে গেলাম এবং যা দেখলাম তাতে আমার অন্তরটা এমনভাবে নাড়া দিয়ে উঠল যে এখনও মনে করলে আমার কাঁপুনি দেয়। এটা ছিল শুকনো বমি, এবং লোকটি সেটার থেকে কিছুটা টুকরো তুলে খেতে যাচ্ছিল। সেই মূহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, আকাশ আমার উপর ভেঙে পড়ছে। কোনোভাবে নিজেকে সংযত করলাম এবং তাকে ডেকে আমার বিস্কুট গুলো দিলাম। আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো অবস্থা তার ছিল না; সে ওখানেই বসে পড়ল আর দুহাত দিয়ে বিস্কিট খেতে লাগল।

ঐ বছরে আমিও কয়েকবার রাস্তার পাশ থেকে খাবার তুলে খেয়েছি। পরিব্রাজক সাধনা আমাকে আনন্দে ভরিয়ে রাখে নি আর ঐ এক বছরে কোন আধ্যাত্মিক অনুভূতিও ঝরে পড়ে নি। কিন্তু ঘটনা হল, এটা আমাকে খিদের সাথে মানিয়ে নিতে শিখিয়েছে। এটা নিশ্চিত যে আমি খিদের জন্য মারা যাব না।

সীমান্তে যখন সমস্যা

যখন আমি গুজরাটের সোমনাথ মন্দির থেকে সমুদ্রতীর বরাবর একটা রাস্তা দিয়ে পোর- বন্দর হেঁটে যাচ্ছিলাম, আমাকে একবার হাইওয়ের পুলিশ আটকে ছিল আর দুবার স্থানীয় গ্রামবাসীরা - যাচাই করতে চেয়েছিল আমি পাকিস্তানের কোন উদ্বাস্তু কিনা। আমার সব জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখল। তারপর থেকে আমি সীমান্তের রাস্তা এড়িয়ে চলতাম।

হিমালয় থেকে আমি অমরনাথ যাত্রা করেছিলাম, সেখান থেকে নেপালের কাঠমান্ডুতে পশুপতিনাথ। পশুপতিনাথ থেকে আমি উত্তর- পূর্বের রাজ্যগুলোতে গেলাম এবং আসামে কামাখ্যা দেবীর মন্দির দর্শন করলাম। যেহেতু ওখানে সবসময় রাস্তায় বি এস এফ এর সৈনিকরা টহল দিত, আমি খুব শীঘ্রই কলকাতার দিকে চলে এলাম। তারপর সম্বলপুর, কাডাপা এবং সবশেষে তামিলনাড়ুতে যখন ফিরে এলাম, আমার মন আনন্দে ভরে উঠলো।

গুরুকে যখন আবার দেখতে পেলাম

সালেম মহাসৎসঙ্গের দিন ঘটনাচক্রে আমি নিজের শহর সালেমেই উপস্থিত ছিলাম। এটা এগারো মাস পরিভ্রমণের পর। আমি মাঠে বসে প্রস্তুতি দেখছিলাম। কোন ব্রহ্মচারী বা ভলেন্টিয়ার আমাকে চিনতে পারে নি, কেবল একজন ছাড়া। আমি মাঠ ছেড়ে চলে গেলাম কিন্তু সন্ধ্যেবেলা সৎসঙ্গে আবার এলাম। খুব অল্প সময়ের জন্য আমি সদগুরুর খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম কিন্তু তারপরেই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলাম। যদিও একজন ভলেন্টিয়ার আমার পিছন পিছন এসে আমাকে একটি রাতের খাবারের প্যাকেট দিয়ে গেল। তার মাত্র কয়েক বছর আগেই ঐ শহরে আমি নিজের বাড়িতে আরামে বাস করেছি। সেই রাত্রে একই শহরে আমি একটি দোকানের সিঁড়িতে ঘুমোলাম। এবং আমি খুব ভালো ঘুমোলাম।

বারো বছরের সাধনার পর বোনাস/ উপহার

২০০৩ এর জানুয়ারীতে কয়েকজন ব্রহ্মচারীকে সন্ন্যাস- ধর্মে দিক্ষা দেওয়া হলো; অবশ্য আমি তাদের মধ্যে ছিলাম না। যদিও বেশ কিছুটা সময় এটা আমাকে কষ্ট দিয়েছিল,পরে আমি বুঝলাম যে -সদগুরুই সবচেয়ে ভালো জানেন। ২০০৬ এর ডিসেম্বরে আমি সন্ন্যাসে দীক্ষিত হলাম , আমার ব্রহ্মচর্য দীক্ষার প্রায় বারো বছর পর। আমাদের ঐতিহ্যে সাধারণভাবে ১২ বছরের সাধনা হল পরবর্তী ধাপের অপেক্ষার পর্ব। ( সন্ন্যাস ) দীক্ষার পর আমার অনেক বন্ধন এবং বাঁধা ধরা স্বভাব দূর হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আমি বুঝলাম যে এটা কোন পদোন্নতি নয়, বরং এক বিলীন হয় যাওয়ার পদ্ধতি। আমার উপলব্ধি হল যে আমি আধ্যাত্মিক জীবনের এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছি, যেখান থেকে আর কোনো ফিরে আসা নেই।

কাল-ভৈরব কর্ম নির্বাহ করা

ছোটবেলায় আমার সবকিছুতেই ভয় করতো। এটা খুবই মজার ব্যাপার যে এখন আমি সবসময়ই, মানুষের শেষ যাত্রায় তাদের জলন্ত দেহের সাথে থাকি। ২০১১ সালে, আমিই প্রথম ব্রহ্মচারী যাকে সদগুরু নিজে ' কালভৈরব কর্ম ' নামের সহজ প্রক্রিয়াটির প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। এখন আরও অনেক ব্রহ্মচারী আছেন যাঁদেরকে এই প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। বাস্তবে আমি সত্যিই এখনও বুঝতে পারি না যে এই প্রক্রিয়ার সময় আদতে কি ঘটে, কিন্তু আমি সদগুরুর দেওয়া নির্দেশগুলো ঠিক সেভাবেই পালন করি। তবে প্রত্যেকদিন এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে নিতে এখন মৃত্যুর সঙ্গে আমার জীবনের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ হয় উঠেছে।আমি এটা অনুভব করি যে একদিন, পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের বাইরে অস্তিত্তের যে খেলা তা আমার অভিজ্ঞতায়ে আসবে।

সদগুরু যতদিন আছেন আমি ততদিন বেঁচে থাকতে চাই

আত্মজ্ঞান লাভ করা আমার লক্ষ্য নয়। আমার সিদ্ধিলাভ সদগুরুর লক্ষ্য, এবং আমি ৫০০% নিশ্চিত যে তিনি এতে বিফল হবেন না। এসব নিয়ে আমার ভাববার প্রয়োজন নেই। আমার এটাই ইচ্ছা, যে এটা যেন আমার শেষ জন্ম না হয় এবং কেবলমাত্র ধ্যান লিঙ্গের আশপাশে থাকার জন্যই আমি আবার ফিরে আসতে চাই। আমার গুরু যখন আরও ৮০ বছর তাঁর সূক্ষ্ম শরীরে এখানে থাকার কথা ঠিক করেছেন, আমি কি করে তাঁর সঙ্গে থাকার এবং তাঁর কাজে লাগতে পারার এই সুযোগ ছাড়তে পারি?