ধর্ম আসলে কী?
সদগুরু মহাভারতের কিছু ঘটনার দৃষ্টান্ত দিয়ে ধর্ম আসলে কী এবং কীভাবে ধর্মের পথে চলতে হয় তা বোঝাবার চেষ্টা করছেন।
সদগুরু: কৃষ্ণ তাঁর সারাটা জীবন ধর্ম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ব্যায় করেছিলেন। অনেককিছুই তাঁর মতো করে হয়েছিল- বেশ কিছু ক্ষেত্রে তিনি যা চেয়েছিলেন তা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। আবার অনেককিছুই তিনি যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে হয় নি এবং মানুষ ধর্মকে তাঁদের ধারণা মতো ব্যাখ্যা এবং অপব্যাখ্যা করতে শুরু করেছিলেন।
কৃষ্ণের জীবনে অনেক মানুষই এই প্রশ্নটি তুলে ধরেছিলেন। যখন দ্রৌপদীর বিবাহের ব্যাবস্থা হচ্ছিল,তখন কৃষ্ণ সবরকম প্রচেষ্টা করেছিলেন যাতে করে তিনি পাঁচজন পান্ডব ভাইদেরই বিবাহ করেন; দ্রৌপদী তাঁকে প্রশ্ন করেন, "ধর্ম কী- তা কি আপনি জানেন?" বা কৃষ্ণ যখন ভীমকে বলেছিলেন, "হস্তিনাপুর দুর্যোধনের হাতে ছেড়ে দাও, চলো নতুন একটা শহর নির্মাণ করি।" ভীম বলেছিলেন, "তুমি একজন বিশ্বাসঘাতক। আমি দুর্যোধনকে হত্যা করতে চাই। আর তুমি আমায় বলছো এই রাজ্যটা তার হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে, আর অন্য কোথাও একদম প্রথম থেকে আরেকটা রাজ্য নির্মাণ করতে? তুমি ধর্মের কী জানো?" একইরকম প্রশ্ন এসেছিল অর্জুন এবং আরও অনেকের থেকেও। লোকজন কৃষ্ণের থেকে কৈফিয়ত চাইতেন, "তুমি কি সত্যিই জানো ধর্ম কী?" কৃষ্ণের প্রতিটি উত্তরে বিস্তারিতভাবে আমি যাবো না কিন্তু সাধারণভাবে কৃষ্ণ স্বীকার করেছিলেন, "এমনকি আমিও কর্মের নিরিখে এই মূহুর্তে ধর্ম কী তা জানি না, কারণ কর্ম পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। যেভাবেই আমরা বিচার করি না কেন, আমাদের অল্প হলেও খামতি থেকে যেতে পারে যখন প্রসঙ্গ আসে বাইরের পরিস্থিতি নিয়ে। কিন্তু যখন আমার স্বধর্মের (জীবনে কারোর নিজস্ব কর্তব্য) প্রসঙ্গ আসে, আমার নিজের মধ্যে আমার কীভাবে থাকা উচিত সেবিষয়ে আমি ১০০% পরিষ্কার।"
স্বধর্ম ও ধর্ম
কোনও বুদ্ধিমান মানুষই কখনও ১০০% নিশ্চিত হন না কীভাবে কাজ করবেন তা নিয়ে; তিনি সবসময় এটা পরখ করেন। একমাত্র কোনো মুর্খ বা একজন অন্ধ-গোঁড়াই ১০০% নিশ্চিত হন। আমরা যা কিছুই করি, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের খাওয়াদাওয়া, জীবন- যাপন ও শ্বাস নেওয়া - তা কোনো না কোনো জীবের প্রতি অবিচার, যদি আপনি বিষয়টি তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। আপনি খেলে, আপনি হত্যা করেন। আপনি শ্বাস নিলে, আপনি হত্যা করেন। আপনি হাঁটলে, আপনি হত্যা করেন। আবার আপনি যদি এসব কিছু করতে না চান আর নিজেকে মেরে ফেলেন, সেটাও আপনি হত্যাই করলেন। বিশ্বের কোনো কর্মই ১০০% সঠিক বা ১০০% ভুল নয়। আপনার কর্মের মাধ্যমে আপনি যে বৃহত্তর ভালোটি তৈরি করছেন, আপনাকে সেটার কথাই বিবেচনা করতে হবে এবং সেইমতো কার্য সম্পাদন করতে হবে।
ধর্ম হলো কেবল আপনার ভেতরে আপনি কেমন তা নিয়েই। যদি আপনি এক সর্বময় - অন্তর্ভুক্তিকরণের অবস্থায় থাকেন, তবে আপনি আপনার বুদ্ধিমত্তা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করবেন। আপনি যদি অন্তর্ভুক্তির অবস্থায় না থাকেন, যদি আপনি "তুমি বনাম আমি" এর অবস্থায় থাকেন, তবে আপনি যাকিছু করবেন সবই ভুল। আপনি সঠিক কিছুই করতে পারবেন না কারণ আপনার অস্তিত্বটাই ভুল কারণ আপনি এটাকে করে তুলেছেন "তুমি বনাম আমি"।
কৃষ্ণের গোটা জীবনটাই ছিল এর নিদর্শন: সেখানে কোনো "তুমি আর আমি" ছিল না, কেবল "আমি আর আমি" অথবা "তুমি আর তুমি"। যখন তিনি গোপীদের সাথে থাকতেনবা যখন তিনি একজন সম্মানিত-রাজব্যক্তিত্ব হিসাবে সক্রিয় ছিলেন বা যখন তিনি গীতার শিক্ষা দিচ্ছিলেন, সবসময় বার্তাটি একই ছিল: অন্তর্ভুক্তিকরণ। একবার যখন সব "আমি আর আমি" হয়ে যায় তখন কর্ম কেবল পরিস্থিতি আর বিবেচনার প্রশ্ন। কোনো কর্মই ১০০% সঠিক বা ১০০% ভুল হতে পারে না। কিন্তু যেটা কৃষ্ণ সবসময় জোর দিতেন এবং যেটা আমিও সবসময়ই জোর দিয়ে আসছি - স্বধর্ম নিয়ে, নিজের ভেতরে কীভাবে থাকতে হয় তা নিয়ে আপনার ১০০% স্পষ্টতা থাকা সম্ভব।
ধর্ম এবং শয়তানের সন্তান
একবার এরকম হয়েছিল - কৃষ্ণ একদল মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাদের প্রত্যেকে তাঁর কাছে এসে তারা ধর্মকে কীভাবে দেখেন তা জানিয়েছিলেন। এটা কৃষ্ণের জীবনে একটা বিশেষ সময়ে ঘটেছিল যখন তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছিলেন তাতে কিছুটা হতাশ ছিলেন। এটা কোনো ব্যক্তিগত হতাশা ছিল না। তিনি এমন মানুষ ছিলেন না যিনি নিজেকে নিয়ে বা নিজের ব্যাপারে হতাশ হবেন। হতাশাটা ছিল তাঁর লক্ষ্যটা অপূর্ণ থাকা নিয়ে। যখন তিনি দেখলেন মানুষ উঠে দাঁড়াচ্ছে না- যেভাবে দাঁড়ানো উচিত, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: "আপনারা সকলে কোন ধর্মের সাথে দাঁড়াতে চান?" একজন ধনী ব্যক্তি এগিয়ে এলেন, একজন হাড়-কৃপণ- যিনি অর্থ উপার্জন ও সঞ্চয় করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন, আর তিনি বললেন, "আমি পন্ডিত বাহ্মণ এবং ভগবানের কাছ থেকে ধর্ম কিনি। আমি আমার পরিবারের ভরণপোষণ করি এবং মন্দিরে গিয়ে পূজো দিই। এটাই আমার ধর্ম।" কৃষ্ণ বললেন, "আপনার ধর্ম হলো লোভের সন্তান। আমি আপনাকে চিনি না।" আর তিনি তাঁকে যেতে দিলেন।
শরীরে নানা পবিত্র চিহ্ন আঁকা এক ব্যক্তি এসে বললেন, "আমি একজন ধার্মিক মানুষ। আমি পাপের পথ থেকে দূরে থাকি। আমি কোনোদিনই হত্যা বা চুরি বা অন্য কোনোরকম পাপ কাজ করিনি। আমি সৎপথে জীবন যাপন করেছি। আমি ঈশ্বরকে ভয় করি।" কৃষ্ণ বললেন, "আপনার ধর্ম ভীতির সন্তান। আমি আপনাকে চিনি না।" এবং তিনি তাকে যেতে দিলেন।
একজন ক্ষত্রিয় কৃষ্ণের কাছে এসে বললেন," আমি আমার ধর্ম জানি। আমি আমার সমস্ত শত্রুদের এবং যারা আমার বিরোধিতা করেছে সকলকে ধ্বংস করেছি। আমি ভগবানকে খুশী করতে বলিদান করি, দরিদ্রকে দান করি আর সকলের কাছে নিজের গুণকীর্তন করি। আমি ব্রাহ্মণ ভোজন করাই এবং তাঁরাও আমার প্রসংশা করেন।" কৃষ্ণ বললেন," আপনার ধর্ম অহংকারের সন্তান। আমি আপনাকে চিনি না।" এবং তাকে যেতে দিলেন।
একজন বিনম্র চেহারার লোক কৃষ্ণের কাছে এলেন আর বললেন, "আমি বিনম্র এবং নিরুপায়। আমি নম্রতার প্রতিমূর্তি। আমি কোন প্রতিবাদ না করে খুশী মনে কষ্টভোগ করি। আমি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঠাণ্ডা এবং এমনকি দুর্ভাগ্যকেও সহ্য করি।" কৃষ্ণ বললেন, "আপনার ধর্ম হলো দাসত্ববৃত্তির সন্তান। আপনার অন্তরের ঈশ্বরকে আপনি জানেন না। আমি আপনাকে চিনি না।" আর তাকে যেতে দিলেন।
চালাকচতুর দেখতে একজন মানুষ এগিয়ে এসে কৃষ্ণকে বললেন, "আমি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ ও সিংহের গুহা থেকে দূরে থাকি এবং এইভাবে আমি নিরাপত্তার পথে চলি। ঈশ্বরের প্রকোপ এড়িয়ে চলি এবং আমি জানি এভাবেই আমি শান্তিতে থাকবো।" কৃষ্ণ বললেন, "আপনার ধর্ম কাপুরুষতার সন্তান। আমি আপনাকে চিনি না।" এবং তাকে যেতে দিলেন।
একজন খুব আত্মবিশ্বাসী, দাম্ভিক দেখতে লোক কৃষ্ণের কাছে এলেন এবং বললেন, "জীবনের ফাঁদ থেকে বাঁচতে, দেহের আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করতে, আমি নিজের এবং অন্যদের মধ্যেকার দুর্বলতাকে নিদারুণ ঘৃণা করি। কঠোর অনাসক্তির সাথে আমি সমস্ত মেলামেশা এড়িয়ে চলি এবং পুরোপুরি নিজের মতো করে সম্পূর্ণ আলাদা থাকি। আমি পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমার কারোর বা কোনও কিছুর দরকার নেই।" কৃষ্ণ বললেন, "আপনার ধর্ম হলো ঔদ্ধত্যের সন্তান। আমি আপনাকে চিনি না।" আর তাকে যেতে দিলেন।
একজন ব্যবসায়ী এসে বললেন, "আমি গরীবকে ভিক্ষাদানের মাধ্যমে ভগবানকে টাকা ধার দিই আর এমনকি আমি খাতায় এর হিসাবও রাখি যাতে হিসাবে ভুল না হয়ে যায়। আমি আমার ধর্মের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করবো।" কৃষ্ণ বললেন, "আপনার ধর্ম হলো ব্যবসার সন্তান। আমি আপনাকে চিনি না।" আর তাকে যেতে দিলেন।
সাধু- সন্তের মতো দেখতে একজন কৃষ্ণের কাছে এলেন আর বললেন, "আমার হল জ্ঞানের ধর্ম। আমি সাধুবাক্য অনুসরণ করে জীবন অতিবাহিত করি। খারাপকে বাধা না দিয়ে নিঃশব্দে কষ্ট সহ্য করি। আমি ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশাধিকার পাবো।" কৃষ্ণ বললেন, "আপনার ধর্ম হল নিস্ক্রিয়তার সন্তান। আমি আপনাকে চিনি না।" আর তাঁকে যেতে দিলেন।
সিল্কের পোশাক পরিহিত, সুন্দরভাবে তেল মাখানো চকচকে চুল বিশিষ্ট একজন লোক আসলেন আর বললেন, "ধর্ম একটা ভ্রম। আমি খাই, আমি নেশা করি, ব্যভিচার করি। আমার দেহই আমার একমাত্র মন্দির৷ আমার দেহের সুখই হলো আমার পূজার আরতি। এর বাইরে আর কিছু হয় না।" কৃষ্ণ বললেন, "আপনি একজন শয়তানের সন্তান। আপনাকে কখনোই ক্ষমা করা হবে না।" এবং তিনি তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন।
এর থেকে যেটা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে তা হল, যদি কেউ তাঁর ভৌত প্রকৃতির প্রতিই কেবল উৎসর্গপ্রাণ থাকেন, তাঁর জন্য কোনও উপায় নেই। কারোর হয়ত ভয়, লোভ, ক্রোধ, উদ্বেগ, কাপুরুষতা, অহংকার এবং আরও অন্যান্য দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যদি ভৌতের চেয়েও বেশি কিছুর জন্য আকাঙ্ক্ষা করেন, তবে তাঁর জন্যেও উপায় আছে ৷
Editor’s Note: Find more stories at the Mahabharat stories page.