হাসি এবং আত্মজ্ঞান - একটি জেন্ গল্প
সদগুরু হাসি নিয়ে মর্মভেদী একটি জেন্ গল্প বলছেন এবং নিজের জীবনের মারাত্মক এক ঘটনার মাধ্যমে এর অর্থ ব্যাখ্যা করছেন।
একটি জেন্ মঠ ছিল যেখানে অনেক ভক্তেরা গুরুর কাছে শিক্ষা নিতে আসত। সমস্ত ভক্তদের মধ্যে, সবচেয়ে নতুন ভক্তটি সর্বাধিক কর্মঠ ছিল আর অনেক কাজ করত। তার গুরু কিছু চাইলে সে সবার আগে তাঁর কাছে পৌঁছে যেত। গুরুর দেওয়া যে কোন কাজ সে তৎক্ষণাৎ সম্পন্ন করত। সে সবার শেষে ঘুমোতে যেত এবং সবার আগে উঠে প্রতিদিনের কাজ শুরু করত। গুরু এসব লক্ষ্য করতেন এবং একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন , "এখানে আসার আগে তুমি কোথায় ছিলে?"
শিষ্যটি বলল , "আমি শ্যালিং কিউ এর কাছে শিক্ষার্জন করেছি।"
"ওহ্, শ্যালিং কিউ ! আমি তার সম্মন্ধে শুনেছি। একবার যখন তিনি সাঁকোর উপর দিয়ে হাঁটছিলেন,পা হড়কে নদীতে পড়ে গেছিলেন। তাই না?" গুরু জিজ্ঞেস করলেন।
"হ্যাঁ, গুরুদেব।"
"তুমি কি জানো, ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন?"
"আমি সেটা জানতাম না। কিন্তু তিনি তার উপলব্ধি নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন।"
"তোমার সেই কবিতাটি মনে আছে ?"
"হ্যাঁ গুরুদেব , আমার মনে আছে।"
"হ্যাঁ গুরুদেব , আমার মনে আছে।"
"তাহলে শোনাও আমাকে।"
"আমি একটা মুক্তো খুঁজে পেয়েছি।
বহুদিন ধরে ধুলো আর ময়লা তার উজ্জ্বলতা ঢেকে রেখেছিল।
এখন সে ধুলো উড়ে গেছে। ময়লাও আর নেই।
জন্ম নিয়েছে উজ্জ্বলতা।
পর্বতমালা এবং নদীগুলো তার আলোকে আলোকিত হয়ে উঠেছে।"
তার কবিতা আবৃত্তি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই গুরু উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।
শিষ্যটি বিভ্রান্ত হয়ে গেল, "কবিতাটিতে এত মজার কি আছে? গুরুদেব কেন হেসে উঠলেন?" কিন্তু অনেক ভেবেও সে তার কোন উত্তর খুঁজে পেল না। সেই রাতে তার ঘুম উড়ে গেল। পরের দিন সকালে ওঠামাত্র সে গুরুর খোঁজ করল।
" গুরুদেব! কালকে যখন আমি কবিতাটি বললাম , আপনি কেন হাসলেন?"
গুরু বললেন,"তুমি একটা জোকারের থেকেও অধম।"
"সেকি?"
"হ্যাঁ, জোকারেরা অন্যদের হাসায়, কিন্তু অন্য কেউ হাসলে তুমি আঁতকে ওঠো" এইকথা বলে, তিনি আবার উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন।
গুরুর এই হাসি শিষ্যটিকে আত্মজ্ঞান প্রদান করল।
সদগুরুর ব্যাখ্যা:
সদগুরু: জেন্ এবং হাসির মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।বেশিরভাগ জেন্ মাস্টারই এই প্রকারের যারা উচ্চস্বরে হাসতেন। আর শুধু জেন্ কেন, যেকোন ব্যক্তি- যিনি নিজের ভেতরে একপ্রকার আনন্দময় স্তরে পৌঁছেছেন, তাঁরা হাসার জন্য কোনো কারণের অপেক্ষা করেন না। তা সে ভালো খবর হোক কি খারাপ , তারা হাসতে পারেন।
আমার যৌবনে ,যখন আত্মজ্ঞান আমার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল , আমি চারপাশে সকলের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম ,"এই মানুষগুলো, যারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মহা-আনন্দে থাকতে সক্ষম , কেন তারা জীবনকে এভাবে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে?" আমার মুখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যেত।
কিন্তু শীঘ্রই যখনই আমি ,আমার চারপাশের লোকজনের মধ্যে অজ্ঞানতা দেখতাম , হাসাটা কাঁদার থেকে বেশি সুখকর উপলব্ধি করলাম। অবিরত চোখের জল ফেলতে থাকার কোনো মানে হয় না।
এই পৃথিবীতে, দারিদ্র বা রোগের থেকেও অজ্ঞানতা অনেক বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে রয়েছে। যখন অজ্ঞানতা দেখতে পান, তার চেয়ে ভালো হাসির সুযোগ আর কী পেতে পারেন? আপনি যদি অজ্ঞতা আর পরমানন্দকে মেলানোর মতো বুদ্ধি রাখেন,তাহলে সত্ত্যিই আর কোনো সমস্যা নেই।
একবার আমি আমেরিকায় পার্বত্য অঞ্চলে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। ঈশার স্বেচ্ছাসেবকেরা অন্য গাড়িতে আমার সাথে যাচ্ছিলেন।
আমার পেছনের গাড়িতে, একজন ঈশা স্বেচ্ছাসেবকের সাথে তিনজন আমেরিকান মহিলা ছিলেন। সাধারণত আমি জোরে গাড়ি চালাই, এবং তারা আমার গতিতে তাদের গাড়ি চালানোর চেষ্টা করছিলেন।
আমি তাদের এই বলে সাবধান করলাম যে, "আমার গতির সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করবেন না।"
তারা বললেন ,"না এই রাস্তা আমাদের পরিচিত ," আর তারা একই গতি বজায় রাখলেন।
পার্বত্য রাস্তাটা একজায়গায় একটা বাঁক নিলো। আমি ওই বাঁকে একই গতি বজায় রাখলাম কিন্তু পেছনের গাড়িটি বাঁকটি সামলাতে পারল না। একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাছে সজোরে ধাক্কা মারল। গাড়ির ধাক্কায় গাছটি কিছুটা হেলে গেল এবং গাড়িটি জন্তু যেভাবে গাছে ওঠে খানিকটা সেইরকম ভাবে আটকে গেল, যার ফলে গাড়িটা অর্ধেক গাছে আর অর্ধেক রাস্তায় ঝুলছিল। ওটা যদি একটু মিস করত , তাহলে চারশো ফুট গভীর একটা উপতক্যায় গিয়ে পড়ত।
পিছনে দেখার আয়না দিয়ে, আমি গাড়িটার গাছে ধাক্কা মারার সময় থেকে প্রতিটি মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আমি আমার গাড়িটি একটু পিছিয়ে এনে দাঁড় করালাম এবং বেরিয়ে এসে তাদের অবস্থা দেখলাম।
ভেতরে মহিলারা সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করছিলেন। গাড়িটি কিনারায় বিপজ্জনকভাবে ঝুলছিল; আর আমরা ধীরে ধীরে প্রত্যেককে সাবধানে গাড়ি থেকে একে একে বের করলাম।
এরকম একটা দুর্ঘটনায় তারা সকলেই মারা যেতে পারতেন । কিন্তু তারা বেঁচে গেলেন । এমনকি এই চরম বিপদ থেকে বেঁচে বেরিয়ে আসার পরেও তারা ওটার সৃষ্টি ভয় আর সন্ত্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিলেন না। আমেরিকান মহিলারা তো আরও জোরে কাঁদতে শুরু করলেন।
কিন্তু ঈশার মহিলাটি বেরিয়ে আসা মাত্রই জোরে জোরে হাসতে শুরু করলেন। যেই মুহূর্তে আমি সেখানে পৌঁছলাম , আমিও অদম্য ভাবে হাসতে শুরু করলাম।
আমেরিকান মহিলারা আর রেগে গেলেন আর চিৎকার করে বললেন ,"আপনি কীভাবে এত দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে ব্যবহার করতে পারেন, যখন আমরা এরকম ভাবে কষ্ট পাচ্ছি ?"
আমি হাসতে হাসতে তাদেরকে বললাম,"আপনারা যদি সবাই মারা যেতেন, আমি এভাবে হাসতাম না। আমি তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতাম আর তারপরে হাসতাম।"
জীবনের যে কোনো সময়ে বা যে কোনো পরিস্থিতিতে, আপনার সামনে যেটা আসছে সেটা আপনি কিভাবে সামলাচ্ছেন তা নির্ভর করে আপনি কতটা অজ্ঞ তার উপর। আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনি কিছুই জানেন না, কিন্তু নিজের মতো করে কিছু কল্পনা করে নেন আর তাতেই আটকে থাকেন। আপনি খুবই অল্প সময়ের জন্য এখানে থাকতে চলেছেন, তাহলে নিজের বোকামোর জন্য এটাকে এরকম জট পাকান কেন?
আপনি হাজারো কারণ বের করতে পারেন আপনার হাসি হারিয়ে ফেলার জন্য। "আমি বাবাকে হারিয়েছি। আমি আমার মাকে হারিয়েছি। আমি স্ত্রীকে হারিয়েছি। আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি। আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি। " আপনি যাই কারণ দেননা কেন , আপনার হাসি হারানোর কোন কারণ নেই।
যদি মানুষ তার হাসি হারিয়ে ফেলে তো তার একটাই কারণ : তারা অজ্ঞানতার চূড়ায় আছে , জীবনের অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে। আপনি যদি পরমানন্দময় স্থিতিতে পৌঁছন , শুধু হাসিই পড়ে থাকে। আপনি যদি একটি মন্দিরের ঘন্টার ধ্বনি শোনেন, আপনি দেখবেন যে এটি একটি অট্টহাস্যের ধ্বনির সবচেয়ে কাছাকাছি। একজন যে তার হাসি ভুলে গেছে , সে সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছে। এটাই সেটা যা জেন্ মাস্টার তার শিষ্যের কাছে প্রদর্শন করেছেন।
Editor’s Note: Read this article, where Sadhguru explains what Zen is and how it came to be such an effective means towards the Ultimate.