মহাভারত পর্ব ১: বৃহস্পতির অভিশাপ এবং তারার সন্তান
কীভাবে পান্ডব এবং কৌরবদের একজন পূর্বপুরুষের জন্ম হয়, সদগুরু আমাদের সেই গল্পটি বলে মহাভারতের কাহিনীর সূচনা করছেন।
গল্পটি বুঝতে হলে চরিত্রগুলোকে আপন করে নিন
সদগুরু: এটাকে "অন্য কারোর" কাহিনী বা ইতিহাসের অংশ হিসেবে দেখলে হবে না, এটিকে নিজের গল্প হিসাবে দেখুন- নিজেকে এর অংশ করে নিয়ে এর সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত হয়ে যেতে হবে। আমরা অন্যের গল্প শুনতে চাই না বরং গল্পটার মধ্যে দিয়ে যেতে চাই৷ যেকথা আমি আগেই বলেছি- আপনার আজকের মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ধর্মবোধ বা ওই ধরণের কোনোকিছু দিয়ে ৫০০০ বছরের আগেকার মানুষদের বিচার করা একেবারেই অনুচিত হবে। আমি চাই আপনারা তাদের মতো করে ভাবুন, তাদের মতো হয়ে তারা যেভাবে অনুভব করেছিল সেভাবেই অনুভব করুন - আজকে যেভাবে ভাবেন সেভাবে নয়। সেই সময় পৃথিবীর সাথে অন্যান্য ধরণের জীবনের নিয়মিত আদানপ্রদান ছিল।মহাভারতের বিভিন্ন দিক আছে যেগুলো আপনার একেবারেই অবিশ্বাস্য মনে হবে কিন্তু কোন কিছুই অবিশ্বাস করা ঠিক নয়। কারণ আমরা একবিংশ শতাব্দীতে রয়েছি এবং কোন কিছুকে আপন করে নেওয়ার বদলে আমরা সেটাকে চুলচেরা বিশ্লেষন করতে পছন্দ করি। কিন্তু এখন আমি চাই যে আপনারা এই গল্পটিকে আপন করে নিন এবং এই চরিত্রগুলিকেও - মানুষ, পশু, যক্ষ, কিন্নর, গণ, দেবতা, দেব -দেবী সবকিছুকেই। তবেই আপনারা বুঝতে পারবেন ওটা কেন ওরকম ছিল; আর সবার উপরে ওগুলো কেন আপনার জন্য প্রাসঙ্গিক। বিচার- বিশ্লেষন করলে আপনি এর মূল ব্যাপারটাই ধরতে পারবেন না।
বৃহস্পতি, ইন্দ্রের প্রধান পুরোহিত
অনেক হাজার বছর আগে একজন শ্রেষ্ঠ মানের পুরোহিত ও পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন - তাঁর নাম ছিল বৃহস্পতি। খুব স্বাভাবিকভাবেই ইন্দ্র- স্বর্গের রাজা তাঁকে তার প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তখন একজন পুরোহিত খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ যুগটা ছিল দ্বাপর যুগ- এমন একটা সময় যখন মানুষের জীবনে আচার-অনুষ্ঠান সবচেয়ে মহত্মপূর্ণ বিষয় ছিল। তারা বিভিন্ন পদার্থ এবং পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের জীবন, আশেপাশের বিভিন্ন পরিস্থিতি বা অন্যদের জীবনে প্রভাব খাটাতে শিখেছিলেন। ভারতের দক্ষিণ ভাগে এই ধর্মানুষ্ঠান ভিত্তিক সংস্কৃতির অবশিষ্ট এখনও থেকে গেছে। কেরালা সম্ভবত দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় এই সব আচার-অনুষ্ঠান অনেকটা বেশি ধরে রেখেছে এবং অনেক বেশি বিশুদ্ধতার সঙ্গে।
বৃহস্পতি এবং তাঁর স্ত্রী তারা
বৃহস্পতির একজন স্ত্রী ছিলেন, তার নাম ছিল তারা। বৃহস্পতি বলতে ওই নামের গ্রহকে বোঝায়। তারা মানে নক্ষত্র। প্রাচীন ভারতে ধর্মানুষ্ঠানে মহিলাদের জায়গা পুরুষদের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই ধরণের ব্যবস্থাপনা, যেখানে একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে ছাড়া একটা ধর্মানুষ্ঠান সম্পন্ন করতে পারবে না - এটা নিশ্চিত করেছিল যে মহিলাদেরও সমান সন্মান থাকবে; যদিও বাইরের জাগতিক পরিস্থিতি কঠোর ছিল। একজন মানুষ তার স্ত্রীকে ছাড়া আশীর্বাদ নিতে পারতেন না। একজন মানুষ তার স্ত্রীকে ছাড়া স্বর্গে যেতে পারতেন না। একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে ছাড়া মুক্তিলাভ করতেন না।
সমস্ত ধর্মানুষ্ঠানগুলিকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল যে কোনোভাবে সমাজ মহিলাদের কোনোরকম অশ্রদ্ধা করতে পারবে না। আজকাল মহিলাদের কিছু স্বাধীনতা আছে বটে কিন্তু দুঃখজনক ভাবে এই স্বাধীনতার সাথে তারা অনেক অধিকার হারাচ্ছেন যেগুলো আগে তাদের ছিল। আজকাল মহিলাদের মোটামুটি সমান অধিকার আছে - আমি "মোটামুটি" বলছি- কারণ আইনের চোখে তারা হয়তো সমান কিন্তু বাস্তবিকতার দিকথেকে সেটা মোটামুটিই।
সমান অধিকারের ক্ষেত্রে এই অগ্রগতি ঘটার একমাত্র কারণ আধুনিক প্রযুক্তি কর্মক্ষেত্রকে কমবেশি সমান পর্যায়ে নিয়ে এসেছে; এমনটা নয় যে সত্যিই মানবতার রূপান্তর ঘটেছে। বৃহস্পতির সময়ে সামাজিক রীতি বা "ধর্ম" এটা নিশ্চিত করেছিল যে একজন নারীকে বঞ্চিত করা, অত্যাচার করা বা অবহেলা করা যাবে না- কারণ একজন পুরুষের জীবনে সেও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। শারীরিক শক্তি আর পেশীর জোরে পুরুষ মহিলাদের মুছে ফেলতে পারতো। কিন্তু স্ত্রী পাশে না থাকলে জীবনে আধ্যাত্মিক দিকটি সম্ভব ছিল না। সেইজন্যই নারীকে মর্যাদা দিতে তারা বাধ্য ছিলেন।
তারা চন্দ্র দেবতার প্রেমে পড়লেন
যদিও তিনি দেবরাজের পুরোহিত ছিলেন, বৃহস্পতি যেসব কাজকর্ম করতেন তার জন্য তারাকে তাঁর প্রয়োজন ছিল। তিনি তাকে ধরে রেখেছিলেন কারণ অন্যথায় তিনি নিজের চাকরিটি হারাতেন। ঔদিকে তিনি নানা জায়গায় প্রেম করে বেড়াতেন। এইসব দেখেশুনে তারা একদিন পূর্ণ চন্দ্রের দিকে তাকালেন এবং চাঁদের দেবতার প্রেমে পড়ে গেলেন। চন্দ্র নিজে পৃথিবীতে নেমে এলেন। তারা অনেক করে প্রেম করলেন এবং কিছুদিন পর তারা চন্দ্রের সঙ্গে পালিয়ে গেলেন।
বৃহস্পতি ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন কারণ এটা শুধু তাঁর স্ত্রীকে হারানো নয় তাঁর চাকরি, তাঁর মানসম্মান, সমাজে তার প্রতিষ্ঠা সবকিছু হারানো; এবং তিনি আর দেবলোকে বা দেবতাদের জগতে প্রবেশ করতে পারবেন না। তিনি ইন্দ্রকে বললেন, "আমি আমার স্ত্রীকে ফেরত চাই। আপনাকে তাকে ফেরত এনে দিতে হবে, অন্যথায় আমি আপনার ধর্মানুষ্ঠান পরিচালনা করবো না।" ইন্দ্র হস্তক্ষেপ করলেন এবং তারাকে ফিরতে বাধ্য করলেন। এমনটা প্রথমবার হলো যেখানে কাউকে একটি নির্দিষ্ট পরিবারিক ধারার মধ্যে থাকতে বাধ্য করা হলো। যখন ইন্দ্র বললেন, "তোমাকে ফিরে যেতে হবে।" তারা বললেন, " না, আমার ভালোবাসা ওই উপরে আছে।" ইন্দ্র বললেন, "তোমার আবেগ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার ধর্ম হলো বৃহস্পতির সঙ্গে থাকা, কারণ তা না হলে আমার ধর্মানুষ্ঠানগুলো সব গোলমাল হয়ে যাবে।" কাজেই তাকে ফেরত আনা হলো।
তারা আর চন্দ্রের সন্তান
তারা গর্ভবতী ছিলেন। বৃহস্পতি জানতে চাইলেন এটি কার সন্তান। তারা কোনো কথা বললেন না। লোকজন জড়ো হলো। তাতেও তারা কোনো কথা বলতে রাজি হলেন না। তখন গর্ভের ভিতর থেকে ভূমিষ্ঠ না হওয়া শিশুটি প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলো, "আমি সত্যিসত্যিই কার সন্তান?" যে কিনা তখনো গর্ভের ভিতরে ছিল, সে জানতে চাইলো আমি কোন বীজ থেকে তৈরী - সেই শিশুটির বুদ্ধির প্রশংসা করে অন্যেরা বললো, "তুমি তোমার স্বামীকে বলতে অস্বীকার করতে পারো, তুমি দেবতাদের বলতে অস্বীকার করতে পারো কিন্তু তুমি তোমার পেটের সন্তানকে প্রত্যাখ্যান করতে পারো না।" তারা বললেন, "এটি চন্দ্রের সন্তান।"
বৃহস্পতি ভীষণ রেগে গেলেন যে তাঁর স্ত্রী অন্য একজনের সন্তান বহন করছেন। তিনি সেই শিশুটিকে অভিশাপ দিলেন এই বলে যে, "তুমি যেন একজন নপুংসক হও - না নারী, না পুরুষ।" শিশুটির জন্ম হলো এবং তার নাম রাখা হল বুধ, এই নামের গ্রহের থেকে। শিশুটি বেড়ে ওঠার সময় তার মায়ের কাছে আক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করল, "আমার কি করা উচিত? আমি কি পুরুষ হিসেবে বাঁচবো না নারী হয়ে? আমার ধর্ম কি? আমি কি সন্ন্যাসী হয়ে যাবো? আমি কি বিবাহ করবো? আমি কাকে বিয়ে করবো, নারীকে না পুরুষকে?" তারা বললেন, "এই সৃষ্টিতে এতসব কোটি কোটি নক্ষত্রের জায়গা আছে, জায়গা আছে অন্য সমস্ত ধরণের জিনিসের জন্য এবং আরও বিভিন্ন প্রকারের জীবের জন্য যারা না নারী না পুরুষ, না দেবতা না দানব। যখন সৃষ্টিতে এই সমস্তকিছুর জন্য জায়গা আছে - তুমি চিন্তা কোরো না, তোমার জন্যও জায়গা আছে। তোমার জন্যও একটা জীবন থাকবে। তুমি নিজের মতো থাকো। জীবন তোমার কাছে আসবে।"
চলবে...
Editor’s Note: A version of this article was originally published in Isha Forest Flower May 2015. Download as PDF on a “name your price, no minimum” basis or subscribe to the print version.