মহাভারত পর্ব ৯: অম্বার প্রতিশোধ স্পৃহা
মহাভারতের এই পর্বে, নিঃসঙ্গ অম্বা ক্রমশ মরিয়া হয়ে এমন একজনকে খুঁজতে থাকেন যিনি ভীষ্মকে হত্যা করবেন আর অম্বার প্রতিশোধ পূর্ণ হবে। তিনি ঘটনার এমন একটি ধারাবাহিকতা শুরু করলেন যার সমাপ্তি বহু বছর পরে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে গিয়ে ঘটবে।
ভীষ্ম পরশুরামের সাথে যুদ্ধ করলেন
তখন অম্বা পরশুরামের খোঁজে গেলেন। পরশুরাম ভীষ্মের অস্ত্রশিক্ষার গুরু ছিলেন - বিশেষত ধনুর্বিদ্যার। অম্বা যখন পরশুরামের কাছে গিয়ে তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে নিজের দুর্দশার কথা ব্যক্ত করলেন - পরশুরাম বললেন, “চিন্তা কোরো না, আমি তোমার সমস্যার সমাধান করবো।” তিনি ভীষ্মকে ডেকে পাঠালেন। ভীষ্ম এসে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। পরশুরাম বললেন, “যথেষ্ট! অনেক হয়েছে তোমার প্রতিজ্ঞা। এবার এই নারীকে বিবাহ করো।" এই প্রথমবার ভীষ্ম বললেন, “আপনি আমার গুরু। আপনি যদি আমায় নিজের মুণ্ডচ্ছেদ করতে বলেন, আমি তা করবো কিন্তু আমায় নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে বলবেন না। আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছি তা আমি ভাঙতে পারবো না।"
পুরো কাহিনী জুড়ে আপনারা দেখবেন- এমন মানুষজন রয়েছেন যাঁরা কোনো শপথ নিলে জীবন-মৃত্যু যাই হোক না কেন, এর ফলাফল যাই ঘটুক না কেন- তাঁরা সেই শপথ রক্ষা করতে চান। এরকম হওয়ার কারণ - সেই সময় মানুষ সম্পূর্ণ বর্বর এক জীবনধারা থেকে সভ্যতা নিয়ে আসার প্রয়াস করছে। এই প্রচেষ্টায় একজন মানুষের কথাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তখন লিখিত কোনো সংবিধান বা দণ্ডবিধি ছিলো না। এরকম একটা অবস্থায় মানুষের কথাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি যদি কিছু বলি, আমি সেটা পালন করবো এবং যে কোনো মূল্যে তা পালন করবো। যখন আইন বলে কিছু নেই, মানুষের কথাই হলো একমাত্র আইন।
কিন্তু পরশুরাম অবাধ্যতায় অভ্যস্ত ছিলেন না। তিনি একেবারে বাধ্য-অনুগত! তাঁর পিতা যখন তাঁকে সব ভাইদের ও মায়ের মুণ্ডচ্ছেদ করতে বলেছিলেন, কিছু না ভেবেই তিনি চারটি মাথা ছিন্ন করে ফেলেন। তাঁর আনুগত্যে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর বাবা বলেছিলেন, "একটা বর প্রার্থনা কর। তুমি কি চাও?" পরশুরাম বলেছিলেন, "আমি চাই আমার মা এবং আমার ভাইয়েরা আবার জীবিত হয়ে উঠুক।" ফলে তাঁর বাবা তাঁদের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
অবাধ্যতা পরশুরাম একেবারেই সহ্য করতে পারেন না কারণ তিনি সেভাবেই বড় হয়েছেন। পরশুরাম যখন দেখলেন ভীষ্ম আদেশ মানতে নারাজ, তিনি প্রচণ্ড রেগে গেলেন এবং তাঁদের দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ বেধে গেলো - সে এক অসাধারণ দ্বন্দ্বযুদ্ধ। কিন্তু পরশুরাম যা কিছু জানতেন তার সবই তিনি ভীষ্মকে শিখিয়েছিলেন আর তাতে তিনি বুঝতে পারলেন যে ভীষ্মকে তিনি পরাজিত করতে পারবেন না। তাঁরা দুজনেই দিনের পর দিন অক্লান্ত ভাবে লড়ে গেলেন আর যখন তাঁরা বুঝতে পারলেন যে কেউই বিজয়ী হতে পারবেন না, পরশুরাম তখন হাত তুলে দিয়ে অম্বাকে বললেন, "তোমায় অন্য কাউকে খুঁজতে হবে।"
কার্তিকের হস্তক্ষেপ
অম্বা হিমালয়ে গিয়ে গভীর কৃচ্ছ্রসাধনায় রত হলেন। তিনি তুষারে ঢাকা শৃঙ্গের উপরে বসে গভীর সাধনায় মগ্ন হলেন এবং শিবের পুত্র কার্তিককে ডাকতে লাগলেন। কার্তিক একজন মহান যোদ্ধা। মনে মনে অম্বা ভেবেছিলেন এই কার্তিকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভীষ্মকে বধ করতে সক্ষম হবেন। তাঁর কৃচ্ছ্রসাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে কার্তিক আবির্ভূত হলেন এবং অম্বা যখন বললেন, "ভীষ্মকে আপনাকে হত্যা করতেই হবে," তিনি জবাব দিলেন, "আমার হত্যার সময় শেষ হয়ে গেছে।"
আপনার যদি না জানা থাকে, কার্তিক দক্ষিণে নেমে এসেছিলেন এবং ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষায় তিনি যা কিছু অন্যায় বলে মনে করেছিলেন সবকিছু হত্যা করেছিলেন। কর্ণাটকের যে জায়গাটা এখন সুব্রমণ্য নামে পরিচিত - তিনি সেই জায়গাতে এসেছিলেন। শেষবারের মতো তিনি তাঁর তরবারি ধুয়ে বলেছিলেন, "এই তরবারি আর কখনও রক্ত দেখবে না"। তিনি হিংসা পরিত্যাগ করেন এবং পাহাড়ে উঠে যান - সেটি আজ কুমার পর্বত নামে পরিচিত; সেখানেই তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন। তাঁর এই বিদেহী অবস্থায় অম্বা যখন তাঁকে ডাকলেন- তিনি বললেন, "আমি ভীষ্মকে হত্যা করতে পারি না, তবে তোমার দুর্দশা এবং তোমার ভক্তি দেখে আমি তোমাকে একটি আশীর্বাদ প্রদান করবো।" তিনি অম্বাকে পদ্মফুলের একটি মালা দিয়ে বললেন, “এই মালাটি নাও। এই মালা যে পরিধান করবে সেই ভীষ্মকে হত্যা করবে।”
এবার মনে বিপুল আশা নিয়ে অম্বা এই মালা হাতে নিয়ে আবারও বেড়িয়ে পড়লেন - এই মালাই সবসময় তাঁর বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমবার যখন তিনি মালা হাতে নিয়েছিলেন, আরেক কান্ড ঘটেছিল। আবারও তিনি মালা হাতে নিলেন - পদ্মফুলের একটি মালা - আর সেই মালা নিয়ে শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, "এমন কি কেউ আছেন যে এই মালা পরে ভীষ্মকে হত্যা করতে রাজী?" কিন্তু কোন ব্যাক্তিই মালাটিকে ছুঁতে রাজী ছিল না।
মালা নিয়ে তাঁর যাত্রা অব্যাহত থাকলো এবং তিনি এসে উপস্থিত হলেন ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাম্রাজ্য পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদের দরবারে। দ্রুপদ কিন্তু অম্বার ধারেকাছেও আসতে চাইলেন না কারণ ইতিমধ্যেই অম্বার দুর্নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ভীষ্মের রক্ত পিপাসু হয়ে তিনি ভূতের মতো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহর থেকে শহরাঞ্চলে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। দ্রুপদ যখন তাঁর সাথে দেখা করতে অস্বীকার করলেন, চূড়ান্ত হতাশায় অম্বা তখন দ্রুপদের প্রাসাদের একটি থামে এই পদ্মফুলগুলিকে ঝুলিয়ে দিয়ে আবারও নিঃসঙ্গ ও বিষণ্ণ অবস্থায় সোজা হিমালয়ে চলে গেলেন। এই পদ্মফুলগুলি তাজাই থেকে গেল আর দ্রুপদ এই মালটাকে এত ভয় পেতেন যে তিনি কাউকে এটা স্পর্শ করতে দিতেন না। প্রতিদিন প্রদীপ জ্বালিয়ে তারা মালাটিকে পুজো করতেন কিন্তু কেউই এটাকে স্পর্শ করেননি, কেউই এর সাথে নিজেকে জড়াতে চাইতো না।
শিবের বর
ধীরে যুবতীর সুন্দর দেহখানি তাজাভাব হারিয়ে একেবারে হাড়-সর্বস্ব হয়ে গেল। নিতান্তই কঙ্কালসার শরীর নিয়ে সেখানে বসে তিনি শিবকে ডাকতে থাকলেন। স্বয়ং শিব উপস্থিত হলেন। অম্বা বললেন, "আপনাকে ভীষ্মকে বধ করতেই হবে।" শিব জবাব দিলেন, “তুমি নিজেই যদি ভীষ্মকে হত্যা করো সেটাই কি সবথেকে ভালো নয়? ভীষ্মকে আমি বধ করার চেয়ে তুমি বধ করলে প্রতিশোধটা আরও বেশি করে উপভোগ করতে পারবে।” অম্বার চোখগুলো হঠাৎ করে জ্বলে উঠলো, তিনি বললেন," এটা কী করে সম্ভব? আমি একজন নারী আর সে এক মহান যোদ্ধা, আমি কীভাবে তাকে মারতে পারি?" শিব জবাব দিলেন,"আমি তোমায় বর দেবো, তোমার পরজন্মে তুমি তাকে বধ করবে।" অম্বা তখন বললেন, “কিন্তু পরজন্মে তো এসবেরই কিছুই আমার মনে থাকবে না, তো প্রতিশোধের মিষ্টতাটাই আমি জানতে পারবো না।” শিব বললেন, “চিন্তা কোরো না। তোমার যাতে মনে থাকে সেটা আমি নিশ্চিত করবো। সময় এলেই তোমার মনে পড়ে যাবে। প্রতিশোধের মিষ্টতা তুমি জানতে পারবে। তোমার যেসমস্ত ভোগান্তি হয়েছে তার সবই তুমি উসুল করে নিতে পারবে।'' তখন অম্বা সেখানে বসেই দেহত্যাগ করলেন, আবার ফিরে আসবেন বলে।
চলবে...
Editor’s Note: A version of this article was originally published in Isha Forest Flower September 2015. Download as PDF on a “name your price, no minimum” basis or subscribe to the print version.