মহাভারত পর্ব ৭: দেবব্রত ভীষ্ম হয়ে উঠলেন
মহাভারতের এই পর্বে, আমরা শুরু করবো যেখানে গঙ্গা শান্তনুকে দেবব্রতের কাছে ছেড়ে যাচ্ছেন এবং দেখবো দেবব্রত কীভাবে ভীষ্ম নামে পরিচিত হলেন।
ধীবর রাজকন্যা মৎস্যগন্ধী
সদগুরু: একবার চেদীর রাজা উপরিচর সপ্তাহের পর সপ্তাহ অরণ্যে থেকে শিকার করছিলেন। সেই সময়ে এক ধীবর কন্যার সাথে তাঁর সন্তান হয়। তিনি যমজ সন্তান প্রসব করলে তাঁদের নাম রাখা হয় মৎস্যরাজা ও মৎস্যগন্ধী। রাজা পুত্রটিকে সঙ্গে করে নিয়ে যান ও কন্যাটিকে রেখে যান মৎস্যজীবীদের কাছে। মৎস্যজীবীদের মধ্যে থাকতে থাকতে মেয়েটি মৎস্যগন্ধী নামে পরিচিত হন, যার অর্থ হলো "মাছের গন্ধ।"মৎস্যগন্ধী একজন আকর্ষণীয় শ্যামবর্ণ মেয়ে হয়ে বেড়ে উঠলো। ধীবর প্রধান, যিনি দাস নামে পরিচিত ছিলেন- তিনি তাঁকে ভালোভাবে বড়ো করে তোলেন। পরাশর, যিনি অগাধ জ্ঞানী এবং আত্মজ্ঞানী মানুষ ছিলেন - একবার তাঁর আশ্রম আক্রমণ করা হয় এবং তিনি এমনভাবে আহত হন যে তাঁর পায়ে গুরুতর চোট লাগে। তিনি কোনওভাবে পালাতে সক্ষম হন এবং অতি কষ্টে জেলেদের একটি ছোট্ট দ্বীপে এসে উপস্থিত হন। তাঁর অবস্থা দেখে জেলেরা তাঁকে আশ্রয় দেয়। মৎস্যগন্ধীর তত্ত্বাবধানে তাঁকে রাখা হয়।
স্বাভাবিকভাবেই মৎস্যগন্ধী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন কারণ তিনি অগাধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী এমনই এক বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মৎস্যগন্ধী সবসময় নিজের মনের মধ্যে দ্বন্দ্বে ভুগতেন কারণ তাঁরই যমজ ভাই থাকতেন রাজপ্রাসাদে আর তিনি কিনা জেলেদের সাথে। তিনি ভেবেছিলেন এই মুনির অনুষঙ্গে এসে তাঁর যদি কোনো একটা সুরাহা হয়। নদীর মধ্যে একটি ছোট্ট দ্বীপে তাঁরা থাকতেন এবং সেখানেই তাঁদের একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। দ্বীপে জন্ম হয়েছিল বলে তাঁকে দ্বৈপায়ন বলে ডাকা হতো। আবার গায়ের রঙ কালো বলে তাঁকে কৃষ্ণও বলা হত। পরবর্তীকালে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস নামে পরিচিত হন। বেদব্যাস- কারণ তিনি বেদের সংকলক আবার তিনিই মহাভারতের কাহিনী বলেছিলেন।
পরাশর পুত্রটিকে নিয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে তিনি মৎস্যগন্ধীকে বরদান করেন যে মাছের গন্ধ চলে গিয়ে তিনি যেন স্বর্গীয় সৌরভের অধিকারিণী হন, যা এর আগে কোনও মানুষ আঘ্রাণ করেনি। তাঁর গন্ধ ছিল ফুলের মতন- সে ফুল এজগতের নয়। এই বিস্ময়কর সুগন্ধের জন্য লোকে তাঁর নাম বদলে সত্যবতী করে দেন। সত্যবতী মানে "সত্যের ঘ্রাণ," আর এটাই তাঁর আকর্ষণ হয়ে ওঠে।
সত্যবতীকে বিবাহের জন্য শান্তনুর আকুতি
একদিন শান্তনু এই নারীকে দেখেন এবং তাঁর প্রেমে পড়ে যান। তিনি সত্যবতীর পিতার কাছে যান এবং বিবাহের জন্য তার পাণিপ্রার্থনা করেন। ধীবর প্রধান, দাস - যিনি আপন ক্ষমতাবলে ছোটখাটো এক রাজা ছিলেন; তিনি যখন দেখলেন যে স্বয়ং সম্রাট তাঁর পালিতা কন্যার পাণিপ্রার্থনা করছেন, তিনি ভাবলেন এটাই চুক্তি করার সঠিক সময়। তিনি বললেন, "আমি আপনার সাথে আমার মেয়ের বিবাহ দিতে তখনই রাজী হবো - যদি একমাত্র তাঁর সন্তান-সন্ততিরাই কুরু বংশের ভাবী রাজা হয়।" শান্তনু বললেন, "এ হতে পারে না। ইতিমধ্যেই আমি আমার পুত্র দেবব্রতকে রাজপদে অধিষ্ঠিত করেছি। কুরু রাজ্যের জন্য সেই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা।"
রাজার দিকে তাকিয়ে ধূর্ত ধীবর বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন, তাই তিনি বললেন "তাহলে আমার মেয়ের কথা ভুলে যান।" শান্তনু অনুনয়-বিনয় করতে লাগলেন। তিনি যতই কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন, ধীবর ততই বুঝতে পারলেন যে তিনি তাঁর বড়শিতে আটকা পড়েছেন। বড় মাছটিকে ধরার সময় হয়েছে। তিনি বললেন "এবার আপনার ব্যাপার। আপনি যদি আমার কন্যাকে চান, তাহলে তাঁর সন্তানরাই যেন ভবিষ্যতে রাজা হয়। নইলে নিজের প্রাসাদে গিয়ে আনন্দে জীবন কাটান।"
শান্তনু প্রাসাদে ফিরে গেলেন - আবারও বিষাদগ্রস্ত। তিনি সত্যবতীকে মন থেকে সরাতে পারছিলেন না। সত্যবতীর সুগন্ধ তাঁকে এমনভাবে আবিষ্ট করে ফেলেছিল যে আবারও তিনি রাজকার্যে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন এবং কেবল বসে থাকতেন। দেবব্রত পিতার এই অবস্থা দেখে বললেন, "রাজ্যের সব কিছুই তো খুব সুষ্ঠুভাবে চলছে, তাহলে কি নিয়ে আপনি এত চিন্তিত?" শান্তনু কেবল মাথা নাড়লেন এবং লজ্জায় মাথা নত করলেন, ছেলেকে তাঁর সমস্যার কথা বলতে পারলেন না।
দেবব্রত যেমন কর্তব্যপরায়ণ পুত্র, তিনি যে সারথি শান্তনুকে মৃগয়ায় নিয়ে গেছিলেন, তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "এই শিকারে যাওয়ার পর থেকেই আমার পিতা আর আগের মতো নেই। কী ঘটেছিল ওনার সাথে?" সারথি বললো, "ঠিক কী ঘটেছিল আমি জানি না। আমি ওনাকে ঐ ধীবর প্রধানের বাড়িতে নিয়ে যাই। আপনার পিতা প্রবল উৎসাহে পরম অনুরাগ নিয়ে সে বাড়িতে রাজার মতো প্রবেশ করলেন। যখন তিনি বেরিয়ে এলেন, যেন এক ছায়ামূর্তি।"
দেবব্রত ভীষ্ম হয়ে উঠলেন
কী ঘটেছিল তা জানার জন্য দেবব্রত নিজে সেখানে গেলেন। দাস বললেন, "উনি আমার কন্যাকে চান। আমার বক্তব্য শুধু এটুকুই যে আমার কন্যার সন্তান-সন্ততিরা যেন ভবিষ্যতে রাজা হয়। এটা খুবই সাধারণ একটা শর্ত। একটাই সমস্যা - তুমি মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছো।" দেবব্রত বললেন,"এটা কোনো সমস্যা নয়। আমার রাজা হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি প্রতিজ্ঞা করছি-আমি কখনোই রাজা হবো না। সত্যবতীর সন্তানরাই রাজপদে অধিষ্ঠিত হবে।" ধীবর মৃদু হেসে বললেন, "একজন নবযুবক হিসেবে, বাহাদুরি দেখিয়ে তুমি এসব কথা বলতেই পারো- কিন্তু পরে যখন তোমার ছেলেপুলে হবে, তারা সিংহাসনের জন্য লড়াই করবে।" তখন দেবব্রত বললেন, "সত্যবতীর সন্তানরাই যাতে রাজা হওয়ার অধিকার পায় তা নিশ্চিত করতে আমি কখনোই বিবাহ করবো না বা সন্তানের জন্ম দেবো না।"
ধীবর তখন সাবধানে মাছের কাঁটা বেছে ভোজন করছিলেন। তিনি মুখ তুলে বললেন, "হে তরুণ, তুমি যাকিছু বলছো, তা সবই আমি প্রশংসা করছি। কিন্তু জীবনের গতিবিধি তুমি জানো না। বিবাহ না করেও তুমি সন্তানের জন্ম দিতে পারো।" তখন দেবব্রত মুষ্কচ্ছেদ করে নিজেকে নপুংসকে পরিণত করার চরম পদক্ষেপ নিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন : "আমি কখনোই সন্তানের জন্ম দেবো না। আমি এখন সন্তানের জন্মদানে অক্ষম। এবার আপনি সন্তুষ্ট?" অবশেষে ধীবর মত দিলেন। সকলে বললেন, "এ হল সবচেয়ে কঠোর কাজ- যা কেউ নিজের সঙ্গে করতে পারে।" তাই লোকে তাঁকে ভীষ্ম নামে ডাকতে লাগলো। ভীষ্ম- মানে যিনি কারুর কোনও বলপ্রয়োগ ছাড়াই নিজের ওপর ভয়ঙ্কর কঠোর হয়ে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন। কাজেই এবার শান্তনু সত্যবতীকে বিবাহ করলেন।
ক্রমশঃ প্রকাশ্য....
Editor’s Note: A version of this article was originally published in Isha Forest Flower June 2015. Download as PDF on a “name your price, no minimum” basis or subscribe to the print version.