মহাভারত পর্ব ৫: শান্তনুর সাথে গঙ্গার সাক্ষাৎ
গত সপ্তাহে আমরা দেখেছি- কীভাবে শকুন্তলার সাথে দুষ্মন্তের সাক্ষাৎ হয় এবং ভরতের জন্ম হয়। এই গল্পে, সদগুরু আমাদের ভরতের বুদ্ধিমত্তার কথা ও তাঁর বংশধর শান্তনুর সাথে কীভাবে গঙ্গার সাক্ষাৎ হয়- সেই কথা বলে মহাভারতের কাহিনীকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বিতথ নামের একটি ছেলেকে খুঁজে পান- যিনি মমতার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন। মমতা হলেন বৃহস্পতির ভাইয়ের স্ত্রী। বৃহস্পতি চরম হঠকারিতার এক মুহূর্তে মমতার ওপর চড়াও হন ও বিতথের জন্ম হয়। ভরত এই ছেলেটিকেই রাজা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। বিতথ একজন মহান রাজা হয়েছিলেন এবং দুর্দান্ত জ্ঞান ও ভারসাম্যের সাথে আজীবন রাজ্যশাসন করেছিলেন। বিতথের চোদ্দ প্রজন্ম পরে আসেন শান্তনু, আর এইবার আমরা মূল কাহিনীতে ঢুকছি!
শান্তনু ছিলেন পাণ্ডব এবং কৌরবদের প্রপিতামহ। শান্তনু তাঁর পূর্বজন্মে মহাভিষেক নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি একটি সম্পূর্ণ জীবন যাপন করে দেবলোকে প্রবেশ করেন। ইন্দ্রের সভায় তিনি বসে আছেন, এমন সময় দেবী গঙ্গা সেখানে আসেন। এরকম ঘটে যে এক মুহূর্তের অসচেতনতায় তাঁর বস্ত্র পড়ে যায় এবং তাঁর শরীরের ঊর্ধ্বভাগ অনাবৃত হয়ে পড়ে। সেযুগের যথাযথ আচরণ অনুযায়ী সবাই তাঁদের চোখ সরিয়ে নেন। দেবলোকে নতুন, মহাভিষেক তাঁর দিকে তাকিয়েই থেকে যান। ইন্দ্র যখন এই অশোভন ব্যাপারটি লক্ষ্য করলেন, তিনি বললেন, "তুমি দেবলোকে থাকার অযোগ্য। ফিরে গিয়ে আবার মানুষ রূপে জন্ম নাও।" তারপর ইন্দ্র লক্ষ্য করলেন যে গঙ্গাও দৃষ্টিটি উপভোগ করেছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, "এটা একেবারেই অসঙ্গত। তুমি দৃষ্টিটি উপভোগ করেছো বলে মনে হচ্ছে। তুমিও গিয়ে আবার মানুষ হয়ে জন্ম নাও। মানুষ হওয়ার সকল সুখ-দুঃখ ভোগ করো। যখন এই গর্ববোধ থেকে মুক্ত হবে তখন ফিরে আসতে পারো।"
কাজেই গঙ্গার সাথে শান্তনুর দেখা হতেই হবে; কিন্তু তিনি এবিষয়ে সচেতন নন কারণ তাঁর পূর্বজন্মের কোনো স্মৃতি নেই। কিন্তু গঙ্গা তাঁর স্মৃতি ধরে রেখেছিলেন এবং শান্তনুকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রাজা হওয়ায় তিনি চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। শান্তনু একজন নিপুণ শিকারী ছিলেন এবং তিনি যখন মৃগয়ায় যেতেন- সেই কাজে তিনি এতটাই একাত্ম হয়ে যেতেন, তাঁর কাছে মৃগয়াই ছিল তাঁর উপাসনা।
একবার টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে তিনি গঙ্গার তীরে মৃগয়ায় বেরিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি তাঁর শিকারে এতটাই গভীরভাবে মগ্ন ছিলেন যে নদীর দিকে কোনো মনোযোগই দিলেন না। রাজা হওয়ায়, যখনই তিনি তৃষ্ণার্ত বা ক্ষুধার্ত বোধ করতেন- তাঁর সেবকদল সবসময় আশেপাশেই থাকতো। কিন্তু একদিন, তিনি খুবই তৃষ্ণার্ত বোধ করলেন আর সেদিন আশেপাশে কেউ ছিল না। তখন তিনি নদীর কথা ভাবলেন এবং সেখানে এলেন। তক্ষুনি গঙ্গা একজন নারীরূপে নদী থেকে উঠে এলেন এবং তাঁর দিকে যখন শান্তনুর চোখ পড়ল - তিনি পুরোপুরি তাঁর প্রেমে পড়ে যান। শান্তনু তাঁর কাছে মিনতি করতে লাগলেন - যাতে গঙ্গা তাঁকে বিবাহ করেন। গঙ্গা রাজী হলেন, কিন্তু একটি শর্ত রাখলেন, "আমি আপনাকে বিবাহ করবো, কিন্তু আমি যাই করি না কেন- আপনি আমায় কক্ষনো জিজ্ঞাসা করতে পারবেন না যে আমি এটা কেন করছি।"
নারীদের এরকম শর্ত রাখার একটা ইতিহাস রয়েছে। পুরু- যিনি কুরুদের মধ্যে প্রথম, উর্বশীর প্রেমে পড়েছিলেন, যিনি একজন অপ্সরা। আর যখন তিনি তাঁকে বিবাহের কথা বললেন- তিনি বললেন,"দুটি শর্ত আছে। একটি শর্ত হল, আমার কতকগুলি পোষা ছাগল আছে। যাই হোক না কেন, আপনাকে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যেন ছাগলগুলি সুরক্ষিত থাকে। সে আপনাকে নিজের গোটা সৈন্যবাহিনী ব্যবহার করে হলেও আমার ছাগলগুলিকে রক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয় শর্তটি হল, আপনাকে যেন অন্য কেউ নগ্ন অবস্থায় কখনও না দেখে।"
এরকম ঘটেছিল যে দেবতারা চাইছিলেন উর্বশী ফিরে আসুক, তো উর্বশী ও পুরু যখন শয্যায় ছিলেন- তাঁরা এসে ছাগলগুলিকে চুরি করে নিয়ে যান। উর্বশী যখন চিৎকার করে ওঠেন, "আমার ছাগল, ওদের কেউ নিয়ে চলে যাচ্ছে!" পুরু উঠে পড়ে চোর ধরতে দৌড়ালেন। ইন্দ্র সুযোগ দেখে বজ্রবিদ্যুৎ প্রেরণ করলেন। গোটা এলাকাটি আলোকিত হয়ে উঠলো আর পুরুকে নগ্ন অবস্থায় দেখা গেল। উর্বশী তৎক্ষণাৎ বলে ওঠলেন, "আপনি শর্তভঙ্গ করেছেন। আমি চললাম।" তিনি সেই যে গেলেন আর কখনও ফিরে আসেন নি।
ইতিহাসে সময়ের সাথে সাথে যেমন কিছু জিনিসের পরিবর্তন ঘটে, নারীও পুরুষের ওপর যৌক্তিক বা অযৌক্তিক শর্ত আরোপ করার এই সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন। মহাভারতের গল্পের মধ্যেই আপনি এটা দেখতে পাবেন যে সমাজ কীভাবে ধীরে ধীরে মাতৃতান্ত্রিক থেকে পুরুষতান্ত্রিকে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।
গল্পে ফিরে আসছি, যেখানে শান্তনু গঙ্গার প্রেমে এতটাই পাগল ছিলেন যে গঙ্গা যা কিছু চাইলেন তিনি তাতেই রাজী হয়ে গেলেন। তো গঙ্গা তাঁর অসম্ভব সুন্দর এবং চমৎকার স্ত্রী হয়ে উঠলেন, এবং তারপর তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলেন।
চলবে...
Editor’s Note: A version of this article was originally published in Isha Forest Flower June 2015. Download as PDF on a “name your price, no minimum” basis or subscribe to the print version.