পারিবারিক সম্পর্ক - আমরা কি খুবই স্বার্থপর?
চলচ্চিত্র নির্মাতা কুনাল কোহলি সদগুরুর সাথে ভোপালে কথোপকথন করছিলেন। এখানে তারই এক উদ্ধৃতাংশ - যেখানে তাঁরা প্রেম, সম্পর্ক ও পরিবার নিয়ে কথা বলছেন।
কুনাল কোহলি : আমি একটা খুবই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে, যখন বেশিরভাগ মহিলারা বাড়ির বাইরে কাজ করতেন না, আমার মাকে সেটা করতে হতো - আমাদের সাহায্য করার জন্য, কারণ আমার বাবা কাজ করায় আগ্রহী ছিলেন না। মা আমাকে ও আমার বোনকে বড় করেছেন, দেশের সবচেয়ে ভালো স্কুলগুলোর মধ্যে একটিতে পড়তে পাঠিয়েছেন, এবং আমার বোনের বিয়ে দিয়েছেন। শুধু আর্থিক ভাবেই নয়, এমনকি আবেগের দিক থেকেও আমার বাবা আমাদের জন্য সত্যিই কোনোদিন ছিলেন না।
সম্প্রতি তিনি হাসপাতালে ছিলেন, আর চিকিৎসকেরা যখন বললেন, "আর কোনো আশা নেই," আমার কিছুই মনে হয়নি, কারণ বাবার সাথে আমার সেই সম্পর্কই ছিল না। আর আমি নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করি - আমি কি একজন খারাপ লোক? আমি কি তিনি যেমন ছিলেন, সেরকমই হয়ে যাচ্ছি? তারপর তিনি ঠিক হয়ে যান আর বাড়ি ফিরে যেতে পারেন, তাও আমি কিছুই অনুভব করিনি। যদি আমার মায়ের জ্বর হয় বা তাঁর অন্যকিছু হলে, আমি ছুটে যাই। আর এখানে সেই মানুষটি, যিনি আমার বাবা - আর আমি কিছুই অনুভব করিনি। এটা কি এইজন্যই যে তিনি আমার জন্যে কিছু করেননি? আমাদের অনুভূতিগুলো কি স্বার্থপর, এমনকি আমাদের বাবা-মা'দের প্রতিও?
সদগুরু: নিঃস্বার্থ বলে কোনো জিনিস হয় না। সবকিছুই নিজেকে নিয়ে। আর অন্য কোনো রাস্তা নেই। আপনার চিন্তাভাবনা আর আবেগগুলো মূলত আপনার ভেতর থেকে - তো সেগুলো আত্ম-কেন্দ্রিক হতে বাধ্য। প্রশ্ন শুধু- আপনি আপনার আত্মকেন্দ্রিকতা নিয়ে কৃপণ না উদার। আপনার আত্মকেন্দ্রিকতা কি শুধু তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করে যাঁরা কোন না কোন ভাবে আপনার শরীরের সাথে সম্বন্ধ যুক্ত; যে তাঁরা অবশ্যই আপনার স্বামী বা স্ত্রী বা সন্তান, আপনার বাবা - মা,ভাই বা বোন হতে হবে, বা অন্য কথায় আপনার পরিবার ? নাকি আপনার আত্মকেন্দ্রিকতা আরও বৃহত্তর- সমগ্র মনুষ্যজাতি সমেত, বা এমনকি প্রতিটি জীব তার অন্তর্ভুক্ত?
এটা স্বার্থপরতার প্রশ্ন নয়। এটা "কঞ্জুস" হওয়ার ব্যাপার। ।আপনি জানেন, এর মানে কম জুস - কম রস। আপনার চারপাশের সমস্ত জীবনকে অনুভব করার জন্য যথেষ্ট রস আপনার নেই, তো আপনি শুধু আপনার জীবনে কয়েকজন মানুষের জন্য অনুভব করেন।
যখন এটা ভৌত বা আর্থিক ব্যাপারের ক্ষেত্রে হয়,আপনি হয়তো শুধুমাত্র কয়েকজন মানুষের দেখাশোনা করতে পারেন। কিন্তু এটা যখন চিন্তাভাবনা আর আবেগের ক্ষেত্রে হয়- সেখানে কোনো অভাব নেই। আপনি ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি জীবের সাথে স্পন্দিত হতে পারেন ও সাড়া দিতে পারেন। সমস্যাটি হল আপনার মধ্যে যথেষ্ট রস, যথেষ্ট জীবন নেই। যদি আপনার মধ্যে যথেষ্ট জীবন থাকে - আপনি প্রতিটি জীব, প্রতিটি কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়, গাছপালা, পশুপাখি- সবকিছুর জন্য অনুভব করতে পারেন। আপনার জীবনকে সমৃদ্ধ করার সেটাই উপায়। জীবন একটা সংক্ষিপ্ত পরিমাণ সময়।.
কুনাল কোহলি: আমি আপনার " কম জুস" বিষয়টির সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত নই, কারণ আমি অনুভব করি যে আমার মধ্যে দেওয়ার জন্য অনেক ভালোবাসা আছে। এমনকি আমি হয়তো এখন কিঞ্চিৎ আপত্তিকর কিছু বলতে পারি - আমি মনে করি একগামিতা হয়তো সঠিক পথ নয়, কারণ সবার মধ্যে এত প্রেম আছে...
সদগুরু: আমি সেই রসের কথা বলছি না। সেটা হরমোনের ব্যাপার। আমি জীবনের অপরিহার্য রসের কথা বলছি। যখন এটা শারীরিক ব্যাপারের ক্ষেত্রে হয়, সবচেয়ে উত্তম যে ওগুলো সীমিত থাকে। ভৌত কখনোই কোনো পরিণাম ছাড়া হয় না। কিন্তু যেটা ভৌত নয়, তার কোন পরিণাম নেই - এতে কিছুই খরচ হয় না। এতে আপনার কি খরচ হয়, ঐ অচেনা মানুষটিকে ভালোবাসতে যাকে আপনি জানেনও না? কি অসুবিধা তাঁর দিকে ভালোবাসা সহকারে তাকাতে? তিনি এটা বুঝবেন কি না সেটা তাঁর সমস্যা। আপনি যদি স্নেহময় হন- এটা আপনার জীবন সুন্দর করে তোলে। আপনার আবেগের মিষ্টত্ব অন্য কারোর বিষয়ে নয়।
কুনাল কোহলি: এতে আমি সহমত।
সদগুরু: আর এটা কারোর দ্বারা প্ররোচিত হওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। এই মুহূর্তে সমস্যাটি হল - আপনার আনন্দ, ভালোবাসা ও অন্যান্য সমস্ত আবেগ - আপনার বিষয়ে যা কিছু সুন্দর - ধাক্কা দিয়ে চালু করতে হয়। অন্য কাউকে এটা ঠেলতে হয়, কেবল তখনই এটা চালু হয়। কিন্তু স্ব-চালিত হওয়ারও একটা উপায় আছে। যদি আপনি স্ব- চালিত থাকেন, সকালবেলা আপনি প্রেমময়, আনন্দময় ও পরমানন্দপূর্ণ ভাবে উঠতে পারেন। অন্যথায় আপনার নিজের মধ্যে একটুখানি উচ্ছ্বাস অনুভব করার জন্যও কাউকে কিছু করতে হবে।
এটা যখন কোন বস্তুগত ও ভৌত বিষয়ে হয়, সেক্ষেত্রে সবসময় একটা সীমানা থাকে যে আপনি কি করতে পারেন, আর কি করতে পারেন না। এটা আপনার নির্বাচন নয়। এটা অস্তিত্বেরই প্রকৃতি। ভৌত জিনিস সবসময়েই সীমিত হতে বাধ্য। কিন্তু যেটা ভৌত নয়, তাকে সীমাবদ্ধ করার কোনও প্রয়োজন নেই, যদি না আপনি আপনার ভৌত অস্তিত্বের সাথে এতো বেশি একাত্ম হন যে পরিণামে আপনি অন্য সবকিছুকেও সীমাবদ্ধ করে ফেলেন। এটাই পৃথিবীতে ঘটে থাকে। এইজন্যই এই সব পরিবারের ব্যাপার। আমি পরিবারের বিপক্ষে নয়, আমি শুধু বলছি- পরিবারকে সম্প্রসারিত করুন।
কুনাল কোহলি: আচ্ছা, এইরকম পরিবার নিয়েই যদি আমাদের এত সমস্যা হয়, আর আমরা যদি এটাকে বাড়িয়েই যেতে থাকি তো এটা আরও বেশি সমস্যার সৃষ্টি করবে।
সদগুরু: আমি দুটি বিবাহ বা বহুবিবাহ করে পরিবার সম্প্রসারনের কথা বলছি না। আমি যা বলতে চাইছি তা হল -যে পরিমাণ আবেগ আপনার থাকতে পারে তার কোনো সীমা নেই। আমি এই হলের গ্যালারির লোকজনকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু কেন ঐ সমস্ত আবছা মুখগুলোর দিকে স্নেহময় ভাবে তাকাব না? এতে আমার কিছুই খরচ হয় না, কিন্তু এটা আমার জীবনকে সুন্দর করে তোলে। আমি যদি তাঁদের দিকে সন্দেহজনক ভাবে তাকাই, এটা আমার জীবনকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলবে। আমি যদি তাঁদের দিকে ঘৃণাপূর্ণ ভাবে তাকাই, এটা আমার জীবনকে কুৎসিত করে তুলবে। তাদের কিছুই ঘটছে না - তারা ব্যালকোনিতেই আছেন।
কুনাল কোহলি: আপনি কি বলছেন যে আমরা আমাদের জীবন, আমাদের আবেগ আর আমাদের চিন্তাভাবনার ওপর অন্য লোকজনদের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দিয়ে ফেলি, যেখানে আসলে আমরা কিভাবে ভাববো আর অনুভব করব সেটা আমাদেরই ভেতরে?
সদগুরু: এটা নির্ভর করে আপনি যেটাকে "জীবন" বলে উল্লেখ করছেন তার উপর। এটা যদি আপনার কাজ, আপনার সম্পর্ক, আপনার পরিবার ও সমাজ, আপনার সম্পত্তি ও ধনসম্পদ, আপনার চিন্তাভাবনা ও আবেগ - এইসব হয়; এগুলো সব আপনি যে মৌলিক জীবন, তার আনুষঙ্গিক উপকরণ মাত্র। শুধুমাত্র আপনি জীবিত আছেন বলেই এইসব আনুষঙ্গিক জিনিসগুলো আপনি জড়ো করেছেন। জীবন আপনার ভেতরে রয়েছে- সবসময় স্পন্দিত হচ্ছে, সে আপনি জাগ্রত থাকুন কি নিদ্রিত।
Editor’s Note: Find more of Sadhguru’s insights about relationships in the ebook “Compulsiveness to Consciousness.”
A version of this article was originally published in Isha Forest Flower September 2015. Download as PDF on a “name your price, no minimum” basis or subscribe to the print version.