রুদ্রাক্ষ কেন ধারণ করবেন?
কেন রুদ্রাক্ষ অন্য সমস্ত বীজের থেকে পৃথক এবং কীভাবে এটি এর ধারণকারীর জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ? এ সবেরই উত্তর দিচ্ছেন সদগুরু।
কেন রুদ্রাক্ষ অন্য সমস্ত বীজের থেকে পৃথক এবং কীভাবে এটি এর ধারণকারীর জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ? এ সবেরই উত্তর দিচ্ছেন সদগুরু।
বাংলায় পড়ুন: রুদ্রাক্ষ
প্রশ্ন:সদগুরু, আপনি কি আমাদের রুদ্রাক্ষ নিয়ে কিছু জানাবেন। কেন এটি অন্য সমস্ত বীজের থেকে আলাদা।
সদগুরু: ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তুরই একটি নির্দিষ্ট প্রতিধ্বনি রয়েছে। আমরা এমন নানা জিনিসকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, যা আমাদের এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে। শুধু রুদ্রাক্ষই নয় — সব রকম গাছপালা, ফুল, জীবজন্তু — সব কিছুকেই ঠিক দু’ভাবে চিহ্নিত করা যায়, কোনটি আমাদের আধ্যাত্মিক পথে সাহায্য করবে, আর কোনটি করবে না। উদাহরণ হিসেবে, ছাগল উপযুক্ত নয়, কিন্তু ষাঁড়, সাপ বা ময়ূর উপযুক্ত, কারণ এই প্রাণীগুলোর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সংবেদনশীলতা আছে।
আমার যখন দশ-এগারো বছর বয়স, তখন দিনের অনেকখানি সময়ই আমি চামুন্ডী পাহাড় আর তার আশেপাশের জঙ্গলে কাটাতাম। তা, সেখানে যদি আমি এক জায়গায় বসেও থাকতাম, তবুও একেক বিকেলে অন্তত পাঁচ থেকে দশটা কেউটে ধরে ফেলতাম আমি। এর কারণ, আমার মধ্যে একটা বিশেষ দক্ষতা তৈরি হয়েছিল।
সে সময়ে অমন একটা ক্ষমতার জন্য খুবই গর্ব হত আমার। বহুকাল বাদে, যখন আমি ধ্যান করতে শুরু করি তখন গিয়ে বুঝেছিলাম যে, সাপগুলোকে আমি খুঁজে পেতাম তা নয়, আসলে সাপগুলোই আমার কাছে চলে আসত। অনেক সময়েই এমন হত যে দুপুর দুটো থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে কখনও হয়তো আমি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে আছি — তার পর যখন চোখ খুলে দেখতাম, কম করেও পাঁচ থেকে আটটা কেউটে এসে জড়ো হয়ে থাকত আমার চারপাশে। যে মুহূর্তে আপনি ধ্যানস্থ হন, তখনই ওরা আপনার দিকে আকর্ষিত হয়। এই ধরনের জীবেরা সেই সকল প্রতিধ্বনির দিকে আকর্ষিত হয় যেগুলোকে আমরা আধ্যাত্মিক বলে গণ্য করি।
একইভাবে, নানা ধরনের পবিত্র ফুলও রয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই মানুষজনকে বলতে শুনেছেন, নির্দিষ্ট একটি ফুল হল শিবের অত্যন্ত প্রিয়, আবার অন্য একটি ফুল হল বিষ্ণুর অতি প্রিয়। আসলে তারা সেই ফুলগুলোকে চিনতে পেরেছিলেন, যাদের প্রতিধ্বনি শিব বা বিষ্ণু কিংবা অন্যান্য শক্তির খুব কাছাকাছি। ওগুলোকে যদি আপনারা ছুঁয়ে দেখেন বা কাছে রাখেন, তবে ওদের একটা নির্দিষ্ট প্রভাব টের পাবেনই। এজন্যই বিভিন্ন দেবতার মন্দিরে শুধু মাত্র নির্দিষ্ট কিছু ফুলই নিবেদন করা হয়।
আমরা যদি নানা রকম ফুল জড়ো করে তার উপরে একটা রুদ্রাক্ষ ধরি, তা হলে হাতেনাতেই এর প্রমাণ পেতে পারি। রুদ্রাক্ষটা যদি ঘড়ির কাঁটা ঘোরার দিকে কোনও ফুলের ওপর ঘোরে তবে বুঝতে হবে সেটা শিবকে দেওয়ার জন্য শুভ। কিন্তু এই পরীক্ষাই যদি একটা কেতকী ফুলের ওপরে করেন, দেখবেন ফুলটাকে রুদ্রাক্ষ পছন্দ করছে না। জানেন তো, পুরাণে এই কেতকী ফুলেরই শিবের সামনে মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার, আর তার শাস্তিস্বরূপ শিবকে অর্ঘ্য দানের ডালি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার একটা কাহিনি আছে? এই সব কাহিনি শোনানো হত আসলে মানুষের মনের মধ্যে বা হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করানোর জন্যই। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল এই যে, প্রতিধ্বনিটাকে মিলতে হবে — আর একমাত্র তখনই একটা সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব।
একইভাবে, বিশ্বের সব কিছুই চিহ্নিত করা হয়েছিল তার প্রতিধ্বনি দিয়ে। রুদ্রাক্ষ হল সেই রকমই একটি বস্তু, যার প্রতিধ্বনির ধরনটি অনন্য। একে শুধু হাতে ধরে থাকলেই আপনারা এর তফাতটুকু বুঝতে পারবেন। আরও বড় কথা, আপনারা যদি তিন থেকে ছ’মাস এই রুদ্রাক্ষ ধারণ করে থাকেন তাহলে জানবেন, এরই মধ্যে এক না একভাবে এটি আপনার শরীরের সঙ্গে মিশে গেছে। এজন্যই প্রতিটি মানুষের রুদ্রাক্ষ আরেকজনের চেয়ে আলাদা হয়। আর ঠিক এ কারণেই নিজের রুদ্রাক্ষ কখনও কাউকে দিতে নেই, কিংবা কখনওই অন্য কারও রুদ্রাক্ষ নিতেও নেই। কারণ আপনার নিজের রুদ্রাক্ষটি যে এর মধ্যেই নির্দিষ্ট কিছু প্রতিধ্বনি সংগ্রহ করে ফেলেছে, যা কিনা আপনার পক্ষে উপকারী তো বটেই, এমনকী এর মধ্যে আপনার কিছুটা অংশও রয়ে গেছে। ঠিক এই কারণেই তামিলনাড়ুতে কেউ কখনও কারও হাত থেকে লবণ, তিলবীজ কিংবা তেল নেবেনই না। এমনকী কারও হাত থেকে একটি লেবুও নেবেন না তারা। এটা এজন্যই যে, কিছু কিছু জিনিস যার সংস্পর্শেই যাক না কেন, অত্যন্ত দ্রুত তাকে শুষে নেওয়ার এক বিচিত্র ক্ষমতা রাখে। বিশেষ করে পাতিলেবুর মধ্যে স্পঞ্জের মতোই একটা ব্যাপার আছে — কারও ভাল দিক বা মন্দ দিককে এটি পুরোপুরি শুষে নিতে পারে। এজন্যই মন্দিরে কিংবা তান্ত্রিকদের কালা জাদুর কাজে এগুলোর এত বেশি ব্যবহার হয়।
রুদ্রাক্ষেরও এই গুণ রয়েছে, এটি আপনার শরীরেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। আপনি যদি দু’-এক বছর প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তই একে ধারণ করে রাখেন, আর তারপর যদি একদিন একে খুলে রেখে ঘুমোতে যান — দেখবেন, আপনি ঘুমোতে পারছেন না। মনে হবে যেন আপনার শরীরেরই কী একটা অঙ্গ হারিয়ে গিয়েছে, কেননা সত্যি সত্যিই রুদ্রাক্ষ ততদিনে আপনার শরীরের এক অঙ্গে পরিণত হয়েছে আর সেভাবেই কাজ করছে — এক অতিরিক্ত অঙ্গ হিসেবে। যে অঙ্গের মূল উদ্দেশ্যই হল আপনাকে ঈশ্বরকৃপা লাভের যোগ্য করে তোলা। কেননা আপনি যোগসাধনাই করুন আর যাই করুন — শেষ কথা তো এই যে, নিজেকে ঈশ্বরকৃপা লাভের যোগ্য করে তুলতেই হবে যদি আপনি নিজের সম্ভাবনা কে বাস্তব দিতে চান। আর এজন্যই সাধকেরা সবার আগে সিদ্ধিলাভ করেন, কারণ তারা যে নিজেদেরই নিবেদন করে দেন। নিবেদনের ওই অনুভূতিটুকু না আনতে পারলে যোগ কিন্তু তখন নিছক এক সার্কাস হয়ে দাঁড়াবে।
রুদ্রাক্ষের আরেকটি ব্যাপার হল, এটি স্বাস্থ্য গড়ে দেয়। যারা গাধার মতন শুধুই একগাদা বছর বেঁচে থাকতে চান, তাদের জন্য এটা জানা খুবই জরুরি। কেননা তারা তো আর কীভাবে বেঁচে আছেন তা নিয়ে আগ্রহী নন, তারা শুধুই বেশিদিন বেঁচে থাকতে চান। কিন্তু কেন ? যদি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোনও মিটার দিয়ে ওদের সুখের মাপ নিতে পারেন, দেখবেন সেই মিটারের কাঁটাটা কখনও ওঠেই না। ওরা ওই বেশিকাল বেঁচে থাকতে চান, স্রেফ মরতে ভয় পান বলেই। নইলে ওদের জীবনে এমন অবাক করা কোনও ঘটনাই তো ঘটে না যার জন্য জীবনকে ওরা অমন আঁকড়ে থাকতে চাইবেন। আসলে মৃত্যুর পর কী ঘটে, সে ধারণা নেই বলেই তাঁরা জীবনকে আঁকড়ে থাকতে চান।
জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে যাই করুন না কেন আপনারা — তা সে আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া হোক বা স্বাস্থ্য, সম্পত্তি কিংবা অন্য যা কিছুই হোক না কেন — একমাত্র ঈশ্বরকৃপা লাভের যোগ্য না হলে কোনও পথেই সাফল্য আসতে পারে না। কিন্তু আপনারা যদি সচেতনভাবেই ঈশ্বরকৃপাকে নিজেদের জীবনের অঙ্গ করে নেন, তখন সব কিছুই এক সহজ ও সুন্দর ভাবে ঘটতে থাকে। স্বচ্ছন্দ ও গতিময় হয়ে ওঠে জীবন। রুদ্রাক্ষ সেই সম্ভাবনাটিকেই বাড়িয়ে তোলে। আর আমরা তো এক্ষেত্রে সব রকম সাহায্যই গ্রহণ করতে চাই, তাই না ?