সংখ্যাহীন জীবন কি আরও সুন্দর হতো ?
কল্পনা করো, একটি সংখ্যাহীন পৃথিবী, যেখানে ঘড়ির কাঁটা, ক্যালেন্ডারের তারিখ অথবা জন্ম শংসাপত্রের বছর নিয়ে কোনও চিন্তা থাকবে না ; সেক্ষেত্রে জীবন কি প্রকৃতির আরও কাছাকাছি থাকতো, আরও আনন্দময় হয়ে উঠতো ? এমনই এক সর্পিল প্রশ্ন এল প্রসূন যোশীর কাছ থেকে, সদগুরুর উদ্দেশ্যে
প্রসূন যোশী: সদগুরু, জীবনে যদি কোনও সংখ্যা না থাকতো, তাহলে কি জীবন আরও সুন্দর হয়ে উঠতো ? বয়স কত, এখন কটা বাজে বা কতটা সময় ঘুমালাম – কিছুই জানা যেত না। সংখ্যাহীন হলে আমি কি প্রকৃতি ও জীবনের ছন্দে আরও বেশি আশ্লিষ্ট হতাম ?
সদগুরু: নমস্কার প্রসূন। আমি জানি, তুমি হলে শব্দের জাদুকর, সংখ্যা তোমার পচ্ছন্দের তালিকায় নেই। আসলে, যখন তুমি বলো, “আমি ও তুমি”, তখন সেখানে দ্বৈত অস্তিত্ব থাকে। এমনকি তুমি যদি শুধু “আমি” বলো, তখনও সেখানে একটি সংখ্যার অস্তিত্ব রয়েছে। সুতরাং, যদি এক সংখ্যাটি থাকে, সেক্ষেত্রে এক দশ, এক শত, এক হাজার বা এক লক্ষের অস্তিত্ব শুধুই তার প্রাকৃতিক পরিণাম। সংখ্যা যে শুধু বেঁচে থাকার বয়স, ঘড়ির সময়ের হিসেব, ঘুম বা জাগরণের সময় গননা করতেই ব্যবহৃত হয় তা নয় – “তুমি” এবং “আমি”, দুটি সংখ্যার দ্যোতক।
ঠিক যে মুহূর্তে তুমি বলো “আমি”, অজান্তেই একটি সংখ্যার জন্ম হয়। সংখ্যার অস্তিত্বের অতীত হওয়ার একমাত্র প্রকরণ হল “শূন্য”। যদি যোগ-এ থাকো, তুমি স্বরূপত তখন “শি-বা”, প্রকৃত অর্থে “যা অস্তিত্বহীন, সেটাই”, অথবা অন্য অর্থে তখন তুমি“শূন্য”, তখন সেই তুমি-র অস্তিত্বটাই নেই।
আক্ষরিক অর্থে “যোগ” হল সংযুক্তিকরণ। যোগ হল, তোমার ব্যক্তি-আমি’র স্বতন্ত্র অস্তিত্বের সীমানাকে মুছে ফেলার প্রকরণগত বিজ্ঞান, সব অর্থেই যা, সেই মৌলিক এক সংখ্যাটি, যা স্বতন্ত্র “আমি”-র দ্যোতক, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। যদি তুমি এক সংখ্যাটিকে সরিয়ে নাও, সেক্ষেত্রে এক মিলিয়ন, এক বিলিয়ন বা এক জিলিয়ন বলে কিছুই থাকে না – সবই তখন শূন্য। সংযুক্ত হওয়ার অর্থ “তুমি ও আমি” অস্তিত্বহীন, নেই কোনও “একাধিক”। তখন রয়ে যায় শুধু এক, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা থাকে না – সবই তখন অস্তিত্বহীন। নানা ভাবে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। কখনও এটাকে বলে “শূন্য”, কখনও বা বলে “শি-বা”। যা “অস্তিত্বময়” তার সংখ্যা হয়। যা “অস্তিত্বহীন”, তা সর্বদাই সংখ্যাহীন।
সংখ্যা হল পার্থিব অস্তিত্বের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি, আর পার্থিব অস্তিত্ব অনিবার্যভাবেই সীমায়িত হয়। “তুমি ও আমি” বিরাজ করি কারণ তোমার অস্তিত্বটি একটি নির্দিষ্ট সীমানা দ্বারা সীমায়িত, শারীরিক ও মানসিক – দু’ভাবেই এটি সীমায়িত এবং পরিণামে তোমার আমি-টি একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রকাশক। এই অবস্থায় তুমি ও আমি দুটি সংখ্যা। পরবর্তীতে থাকে শুধু গুণিতকে বেড়ে যাওয়া।
যদি কখনও এই পার্থিব অস্তিত্বের সীমানাকে অতিক্রম করে যেতে পারো, একমাত্র তখনই সংখ্যাহীন অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। প্রকৃতই সংযুক্তিকরণ হলে সব কিছু যে এক হয়ে ওঠে তা নয়, অস্তিত্বহীন হয়ে ওঠে। আমরা যখন যা সীমায়ীত নয় বা যা অসীম, তার কথা বলি, তখন অনিবার্যভাবেই তা সংখ্যাহীন। নির্দিষ্ট সীমানা না থাকার অর্থ হল এক বা দুই বলে কিছু না থাকা। সম্পূর্ণ সংখ্যাহীন অস্তিত্ব তখনই সম্ভব যখন যোগের সর্বোচ্চ স্তর বা চূড়ান্ত সংযুক্তিকরণকে স্পর্শ করা যায়। আমার যাবতীয় কাজের কেন্দ্রবিন্দু এটাই যে, সংখ্যাহীন অস্তিত্বকে মানুষের প্রত্যক্ষ অনুভূতিতে এনে দেওয়া।
শব্দের যাদুর মতো, সংখ্যার যাদুও মুগ্ধ করে দেয় গণিতের রূপে। শব্দ ও সংখ্যা স্বতন্ত্র কোনও অস্তিত্ব নয়। একটি শব্দ থাকে বলেই অসংখ্য শব্দের জন্ম হয়, একটি সংখ্যা থাকে বলেই অগণিত সংখ্যার জন্ম হয়। এগুলির সবই আসলে পার্থিব অস্তিত্বের প্রকটিত পরিণাম। এই নির্দিষ্ট সীমায়িত পার্থিব অস্তিত্বকে অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হলেই তাকে আমরা বলি “spiritual”। আধ্যাত্মিকতার অন্তর্নিহিত ভাবটি সংখ্যাহীন অস্তিত্বকেই প্রতিফলিত করে।
সম্পাদকের কথা : যে প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ, যদি এমন কোনও বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকে অথবা যদি কোনও আপাত কঠিন প্রশ্ন নিজেকে ক্রমাগত বিব্রত করতে থাকে, সেক্ষেত্রে জীবনের সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সদগুরুকে আপনার প্রশ্ন করুন UnplugWithSadhguru.org.