দোষ ফোনের নয়, দায়ী তোমার আসক্তি
আজকাল আমাদের হাতটা সর্বদাই যেন আঠার মতো ফোনের সাথে লেগে থাকে। সদগুরুর সাথে কথোপকথনের সময় বিষ্মিত রণবীর সিং জানতে চাইলেন যে, প্রযুক্তির জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য প্রযুক্তি ?
রণবীর সিং: স্যর, আমি অনুভব করি দ্রুতগতিতে প্রযুক্তির বিবর্তন ঘটে চলেছে এবং শুধু একটি মোবাইল ফোন আজ আমাদের জীবনকে আপাদমস্তক বদলে দিয়েছে। জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব রয়েছে। যোগাযোগের এই মাধ্যমটিকে দেখে আমি চমৎকৃত হয়ে যাই। আমি আফ্রিকার জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েও উত্তর মেরুতে থাকা কারও সঙ্গে সহজেই কথা বলতে পারি। এমনকি আমি তাদের মুখও দেখতে পারি।
এবং এর সাথে এখন স্যোশাল মিডিয়া এসেছে। এটা সত্যিই সবকিছুকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। আঠারো, উনিশের কিশোর কিশোরীরা এখন এতে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়। তারা এটা অনেক ভাল ব্যবহার করতে জানে। আমি যখন জন্মেছিলাম সেই সময় শুধু ল্যান্ডফোন ছিল, যেখানে কোনও ব্যক্তিকে দেখার কোনও প্রশ্নই ছিল না। সুতরাং মোবাইল ফোনের প্রযুক্তি এবং স্যোশাল মিডিয়ার ব্যাপারে আপনার কি বক্তব্য? এটা কি প্রযুক্তি না মানুষেরই বিবর্তন, যা ছিলাম সেখান থেকে প্রসারিত হতে পেরেছি বলেই কি সেলফোন এসেছে ?
সদগুরু: প্রতিটি যন্ত্র যা আমরা সৃষ্টি করেছি, আসলে তা আমাদেরই নৈপুণ্যকে আরও বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে। আমাদের দেখার শক্তি আছে, তাই আমাদের টেলিস্কোপ এবং মাইক্রোস্কোপ আছে। আমরা কথা বলতে পারি, সুতরাং আমাদের মাইক্রোফোন এবং টেলিফোন রয়েছে। এক সময় আমি ল্যান্ডফোনের মাধ্যমে কথা বলতাম, সেটা তো ঠিকই ছিল। এখন আমার কাছে মোবাইল ফোন আছে যেটা কিনা আরও বেশি আরামদায়ক, অথচ সেটা ঠিক নয়? না, না, এটাও পুরোপুরি ঠিক আছে।
বছর পঁয়ত্রিশ আগে, আমাকে সর্বদাই রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হতো, Isha Foundation- কে প্রসারিত করার লক্ষ্য নিয়ে আমাকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, এক শহর থেকে অন্য শহরে ক্রমাগত ছুটে বেড়াতে হতো। আমি ফোন করার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন পেতাম। আমি জানি না তুমি ফোনের ওই অদ্ভুত নীল রঙের বাক্স দেখেছো কিনা- local,STD,ISD লেখা ওই টেলিফোন বুথগুলোর কথা বলছি। হাইওয়ের ধারে যেখানেই ওই নীল রঙের বাক্স দেখতাম, সেই দিনটাই আমার ফোন করার দিন হতো।
আমার কখনও টেলিফোনের বই ছিল না অথচ আমি খুব সহজেই আটশো বা ন’শো টেলিফোন নম্বর এবং নাম মনে রাখতে পারতাম। সুতরাং যেখানেই ওই টেলিফোন বুথ পেতাম, আমি পাঁচ হাজার টাকা সেই ফোন বুথের ছেলেটাকে দিতাম। কারণটা সে বুঝেই উঠতে পারত না, কিন্তু আমি তাকে বলতাম, “এটা রাখো, এটা আমার ডাউনপেমেন্ট”। সাধারণত, তখন একটা ফোনকলের খরচ হতো পাঁচ বা দশ টাকা। আমি তাকে পাঁচ হাজার টাকা আগেই দিয়ে দিতাম - সে ঠিক বুঝতে পারত না কি হতে চলেছে।
আমি সেই বুথের মধ্যে ঢুকে কালো ও উৎকট গন্ধযুক্ত ফোনটি থেকে ফোন করা শুরু করতাম। ওদের মধ্যে কিছু ফোন সুগন্ধযু্ক্ত হতো, কিন্তু বাদবাকি ফোনগুলিতে প্রত্যেকের মুখের দুর্গন্ধ লেগে থাকত। তখন আমি ফোন করতাম চার,পাঁচ,কী ছ’ঘন্টা ধরে। সারা মাসের জন্য যা ফোন করা দরকার হতো, আমি সেই সব ফোন একদিনে করতাম।
অন্য মানুষজনও যারা ফোন করার জন্য সেখানে আসত, বাইরে না-আসার জন্য আমার প্রতি অঙ্গভঙ্গি করতো, কিন্তু যেহেতু আমি পাঁচ হাজার টাকা আগে থেকেই দিয়ে রাখতাম, ফোন বুথের ছেলেটিই সেইসব মানুষজনদের সামলে নিতো। আমি আমার ফোন শেষ করে গাড়ী চালিয়ে চলে যেতাম। এমন কি সব ফোন করা শেষ হলে আমার আঙুলগুলো ব্যথা করতো।
অথচ আজকাল, যদি আমি কারও সাথে কথা বলতে চাই, তো তার নামটি বললেই ফোনটি নিজে নিজেই কল করতে শুরু করে।
রণবীর সিং: হ্যাঁ।
সদগুরু: সব কিছুই এখন প্রস্তুত করে রাখা আছে। প্রযুক্তির এই উন্নতি আমার কাছে যঠেষ্ট প্রশংসাযোগ্য। কিছু মানুষ অভিযোগ করছে ঠিকই কিন্তু কিন্তু তাদের অভিযোগ প্রযুক্তির জন্য নয়। তারা আদৌ জানে না যে, প্রকৃতপক্ষে তাদের অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তাদেরই নিজস্ব অদম্য প্রবণতার তৈরি বাধ্যবাধকতা (compulsiveness)।
এই বাধ্যবাধকতার জন্য বিপদ যে শুধু ফোনের ক্ষেত্রেই হচ্ছে তা নয়। যদি তারা খাওয়া শুরু করে, তারা জানে না কখন খাওয়া শেষ করতে হবে। যদি তারা পান করতে শুরু করে, জানে না কখন পান বন্ধ করতে হবে। এই বাধ্যবাধকতাই তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকাশিত হচ্ছে। এখন এই গ্যাজেটগুলি তাদের কাছে যেন ড্রাগের নেশায় পরিণত হয়েছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, এই গ্যাজেটের নেশা বহু মানুষকে পান করার নেশা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।
রণবীর সিং: অন্তত কিছু ভাল তো হয়েছে।
সদগুরু: এই অদম্য প্রবণতাগুলিকেই আমাদের সঠিকভাবে সামলানো প্রয়োজন। প্রযুক্তি আমাদের দক্ষতা ও নৈপুণ্য বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে – প্রযুক্তির বিরুদ্ধে কারও কোনও অভিযোগ থাকার কথাই নয়। অন্যথায়, আমরা তোমাকে সেই নীল রঙের খোপে রাখা কালো ফোনটির কাছে ফিরিয়ে দেবো। তবেই তুমি মজাটা টের পাবে!
সম্পাদকের কথা: যে প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ, যদি এমন কোনও বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকে অথবা যদি কোনও আপাত কঠিন প্রশ্ন নিজেকে ক্রমাগত বিব্রত করতে থাকে, সেক্ষেত্রে জীবনের সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সদগুরুকে আপনার প্রশ্ন করুন UnplugWithSadhguru.org.