কর্ম থেকে মোক্ষ
সদগুরু আলোচনা করছেন কর্ম কী, এবং এটি কীভাবে মোক্ষ বা চূড়ান্ত মুক্তির সাথে যুক্ত।
প্রশ্ন: সদগুরু, আপনি কি কর্মতত্ত্বের উপর কিছু আলোকপাত করতে পারেন এবং কীভাবে কেউ মোক্ষ অর্জন করতে পারেন এবং জন্ম ও পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পেতে পারেন?
সদগুরু: কর্ম মানে কাজ। এই যে আপনি এখানে বসে আছেন, আপনি চার ধরণের কার্য সম্পাদন করছেন। আপনার শরীর কিছু করে চলেছে, তা নাহলে আপনি জীবিত থাকবেন না। একইভাবে, আপনার মন, আবেগ এবং জীবনীশক্তিও কিছু না কিছু কাজ সম্পন্ন করছে। এই চারটি আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ঘটছে – জাগ্রত এবং ঘুমন্ত অবস্থায়। আপনার কর্মের, আপনার ক্রিয়াকলাপগুলির ৯৯% এরও বেশি হল অসচেতন। কিন্তু এই কৃতকার্যগুলির স্মৃতির অবশিষ্টাংশ আপনার মধ্যে জমা হতে থাকে।
যেমন ধরুন, আপনি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় হেঁটে গেলেন, পথে ১০ রকমের গন্ধ থেকে থাকতে পারে কিন্তু তেমন তীব্র কিছু না হলে আপনি সেগুলি বাস্তবে লক্ষ্য নাও করতে পারেন। তবে ওই ১০ টি আলাদা আলাদা গন্ধই, যা আপনার নাসারন্ধ্র দিয়ে ঢুকছে, তা কিন্তু আপনার মধ্যে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। মানব দেহতন্ত্র একটি অসাধারণ যন্ত্র। কোনো কিছুই একে এড়িয়ে যেতে পারে না। আপনি এ সম্পর্কে সচেতন থাকুন বা না থাকুন, এটি সব সময় সবকিছুকে ধরে ফেলে এবং রেকর্ড করে নেয়। এই সব স্মৃতির উপর ভিত্তি করে, আপনার বিশেষ বিশেষ প্রবণতা গড়ে ওঠে। এই প্রবণতাগুলির জন্য প্রচলিত শব্দটি হল বাসনা।
আপনার কী ধরণের বাসনা রয়েছে তার উপর নির্ভর করে আপনি কিছু বিশেষ ধরণের জীবন-পরিস্থিতির দিকে ঝুঁকে যান। আমরা বলি "এটি আপনার কর্ম" অর্থাৎ "এটি আপনার করা"। দুর্ভাগ্যক্রমে, কর্ম-কে কোনও কিছুর জন্য শাস্তি বা পুরষ্কার হিসাবে দেখানো হয়। কর্ম কোন শাস্তি নয় বা পুরষ্কারও নয়। এর অর্থ হল আপনি স্মৃতি তৈরি করছেন; আপনি অসচেতনভাবে আপনার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে একটি "সফ্টওয়্যার" তৈরী করে চলেছেন। আপনার সফ্টওয়্যারটি যেরকম তৈরী হয়, সেই অনুসারে হয় আপনার আচরণ, আপনার কাজ এবং আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা।
কর্ম মানে জীবন সম্পূর্ণরূপে আপনার তৈরি। প্রশ্নটা হল, আপনি এটিকে সচেতনভাবে তৈরি করেছেন নাকি অসচেতনভাবে। ওপরের ওই স্বর্গ থেকে কেউ আপনার জীবন পরিচালনা করছেন না। কর্ম মানে আপনি আপনার জীবন তৈরি করেন। যখন আপনি বুঝে যাবেন যে আপনি জীবনের অধিকাংশটাই তৈরি করছেন অসচেতনভাবে, তখন আপনার বুদ্ধিমত্তার পক্ষে যথাসম্ভব সচেতন হওয়ার চেষ্টা করা কি স্বাভাবিক নয়? সচেতনতা হল ইলেক্ট্রিক বাতির ভোল্টেজের মতো। আপনি যদি ভোল্টেজ বাড়িয়ে দেন তবে এটি আপনাকে সমস্ত কিছু দেখায়। যদি ভোল্টেজ কম করেন তবে এটি অল্প একটুই দেখায়। সচেতন হওয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। আপনি যদি আপনার জীবনীশক্তিকে খুব তীব্র করে তোলেন তবে চেতনাও আপনার মধ্যে জ্বলে উঠবে। যদি কোনও তীব্রতা না থাকে, আপনি যদি চেতনা সম্পর্কে শুধুই কথা বলতে থাকেন আর পড়তে থাকেন, তাহলে এটা হবে না।
কর্মকে মুছে ফেলা
আমাদের বুঝতে হবে, ভারতীয় সংস্কৃতিতে, ঈশ্বর আমাদের লক্ষ্য নয়। ঈশ্বর হল আরও একটি উপকরণ। আমাদের কাছে চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং সর্বাধিক মূল্যবান হল মুক্তি, স্বাধীনতা বা মোক্ষ। এই মুহুর্তে স্বর্গকে একটা দারুন জায়গা মনে হতে পারে কিন্তু আপনি যদি সেখানে যান তবে কিছু সময় পর সেটাও আপনার একঘেয়ে লাগবে। তা সে যাইহোক, আপনার কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে যে আপনি ইতিমধ্যে স্বর্গে নেই? আপনি ইতিমধ্যেই স্বর্গে আছেন এবং সেটাকে নষ্ট করছেন! আপনি যদি ইচ্ছুক থাকেন তবে অন্য যে কোনো জায়গার তুলনায় এখানে ঈশ্বরের উপস্থিতি কোন অংশে কম নেই।
মুক্তি মানে হল চক্রটিকে ভাঙা। কেন আপনি চক্রটি ভাঙতে চান? লোকে মনে করে আপনি যদি দুর্দশাগ্রস্ত হন তবেই আপনি চক্রটি ভেঙে ফেলতে চাইবেন। একদমই না। একজন দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি চাইবেন আরও ধনী, আরও ভাল, স্বাস্থ্যবান, লম্বা, আরও সুন্দর, আরও সমস্ত কিছুতে বেশী হয়ে ফিরে আসতে। কেবলমাত্র সেইসব ব্যক্তি যাঁরা জীবনকে তার সমস্ত দিক থেকে দেখেছেন তাঁরা এর বাইরে যেতে চাইবেন। মুক্তির অর্থ আমরা যে কার্মিক তথ্য জমা করেছি তা ক্ষয় করে ফেলতে চাই, যা জীবনকে এতে আটকে রাখছে আর নিজেকে ঘিরে একটি দেহ তৈরি করছে। আপনি যদি এই কার্মিক তথ্যগুলিকে ভেঙে ফেলেন তবে এর মধ্যেকার জীবনটি আর আপনি বা আমি হয়ে থাকবে না, থাকবে কেবল জীবন। এই মহাবিশ্ব জীবিত। তুলনা দিতে হলে – ধরুন আপনি একটি সাবানের বুদবুদ ছাড়লেন, বুদবুদটি বাস্তব। কিন্তু বুদবুদটি যদি ভেঙে যায় তবে কেবল এক ফোঁটা জল নীচে পড়বে। বুদবুদের বাকি অংশ উধাও হয়ে যাবে। বুদবুদে যে বায়ু ছিল তা চারপাশের বাতাসের সাথে মিশে এক হয়ে যাবে।
জীবন কেবল আপনার ভেতরে নয়, এটি আপনার বাইরেও আছে। এজন্য আপনি শ্বাস নিচ্ছেন এবং শ্বাস ছাড়ছেন। তা নাহলে আপনি বাঁচতে পারবেন না। আপনি এটিকে অক্সিজেন বা অন্য কোনও কিছু বলতে পারেন, তবে তাতে কিছু আসে যায় না। মূলত, আপনি যাকে জীবন বলছেন তা সর্বত্র বিস্তৃত। এটি যে জাতীয় তথ্যের সাথে আটকা পড়ে সে অনুযায়ী আচরণ করে। এটাকেই আমরা কর্ম বলে উল্লেখ করি। কর্ম হল সফটওয়্যারের মত। সবকিছুই হল সেই একই জীবনীশক্তি, কিন্তু সাথের সফটওয়্যারটি আলাদা। তাই এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আচরণ করে। আপনি যদি কার্মিক সফটওয়্যারটি পুরোপুরি ভেঙে দেন তবে জীবন কোথায় যাবে? কোথাও না, এটা ওখানেই আছে। কেবল স্বতন্ত্র পরিচয়টা নষ্ট হয়ে যাবে। আসলে, আপনার মধ্যে জীবনের স্বতন্ত্র পরিচয় কখনই থাকে না। শুধুমাত্র আপনার সফটওয়্যারটিই যা পৃথক। যদি অসচেতনভাবে এটি লিখে থাকেন তবে এটি বিচিত্র সব রূপ গ্রহণ করবে, তার মধ্যে কিছু আপনার পছন্দ হতে পারে অন্যগুলো পছন্দ নাও হতে পারে। যদি সচেতনভাবে কার্মিক সফটওয়্যারটি লেখেন তবে আপনি তৈরি করবেন যা আপনি চান।
Editor’s Note: “Mystic’s Musings” includes more of Sadhguru’s wisdom on life, death and the human mechanism. Read the free sample or purchase the ebook.
A version of this article was originally published in the January 2016 Isha Forest Flower. Download as PDF on a “name your price, no minimum” basis or subscribe to the print version.