স্বপ্ন এবং দূরদৃষ্টি – ওপারের চাবিকাঠি
চিত্রনির্মাতা, ফ্যাশন ডিজাইনার, কবি এবং শিল্পী মুজফ্ফর আলীর সঙ্গে কথোপকথনের সময় সদগুরু দূরদৃষ্টি, স্বপ্ন, অতীন্দ্রিয়বাদ এবং গুপ্তবিদ্যার জটিল ব্যাখ্যাকে সহজবোধ্য করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, স্বপ্ন হ'ল মনেরই এক অন্য মাত্রা, কিন্তু মন ও শরীরকে অতিক্রম করতে পারলে পরেই অতীন্দ্রিয় মাত্রা বা স্তরকে স্পর্শ করা যায়।
সদগুরু: যখন আপনারা বলেন, কোনও ব্যক্তির দূরদৃষ্টি রয়েছে, আজকাল এই ‘দূরদৃষ্টি’ কথাটি কোনও বড় স্বপ্নকে বোঝাতে সামাজিক ব্যবহারে পরিণত হয়েছে। না, দূরদৃষ্টির অর্থ স্বপ্ন নয়। দূরদৃষ্টি কথার অর্থ হল, আপনার দেখার ক্ষমতা আছে। যখন আপনি এমন কিছু দেখতে পান যা অধিকাংশ মানুষ দেখতে পাচ্ছেন না, তখন আমরা বলি, ‘ওহ্! তিনি একজন দূরদর্শী। তিনি এমন কিছু দেখছেন যা অন্য মানুষ দেখছেন না।’ তার যদি আপনার চেয়ে বড়ো স্বপ্ন থাকে, সেটা তাকে দূরদর্শী করে না - তিনি তখন আরও বড় একটি সমস্যা।
মুজফ্ফর আলী: তিনি একজন সুবিধাবাদী মানুষ হয়ে ওঠেন।
সদগুরু: যদি আমার এমন একটি বড় স্বপ্ন থাকে যা আর সকলের স্বপ্নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, আমি তাদের সবাইকে আমার স্বপ্নের দিকে চালিত করব। এমন স্বপ্নের প্রয়োজন কী ?
মুজফ্ফর আলী: তাহলে আপনার স্বপ্ন কী ?
সদগুরু: আমি স্বপ্ন দেখি না। আমি বেঁচে থাকি। আমি শুধু পরিপূর্ণ হয়ে বেঁচে থাকি।
মুজফ্ফর আলী: কিন্তু স্বপ্ন দেখা ভাল, তাই না? নাহলে সকলেই বলছে - স্বপ্ন না দেখতে, বড় হয়ে উঠতে, শিখতে, বেঁচে থাকতে। সেক্ষেত্রে স্বপ্নই কেবল মানুষকে বিশুদ্ধ রাখে, তাই না?
সদগুরু: সাধারণত বেশিরভাগ মানুষের স্বপ্নই কুৎসিত হয়। আপনি কি মনে করেন তারা সবাই খুব শুদ্ধ স্বপ্ন দেখছেন? আমি অবশ্যই এটা বলব যে, বিগত পঁচিশ বছরে আমি একটিও স্বপ্ন দেখিনি। যখন আমি ঘুমোই, মড়ার মতো ঘুমোই। যখন জেগে উঠি, আমি সম্পূর্ণ সজাগ। কারণ আমি রাত্রে স্বপ্ন দেখে সময় নষ্ট করি না। আমার জীবনে প্রায় পঁচিশ বছর আমি রাতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। আজকাল আমি একটু অলস হয়ে গেছি এবং চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা ঘুমোচ্ছি।
মনের ওপারে
স্বপ্ন হ'ল অচেতন কল্পনা। কিছু মানুষ তাদের মনের সেই সব ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় প্রবেশ করার জন্য মাঝে মাঝেই স্বপ্নকে ব্যবহার করেছেন, সাধারণ অবস্থায় যে মাত্রাগুলি তাদের নাগালের বাইরে থাকে। সেইজন্য তারা সেই মাত্রাগুলিতে প্রবেশের মাধ্যম হিসেবে স্বপ্নগুলিকে ব্যবহার করেছেন। বিশেষতঃ, কিছু বিশেষ সংস্কৃতি যেমন অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা এবং উত্তর আমেরিকার উপজাতিরা - তারা স্বপ্নকে বড়ভাবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এইসব স্বপ্নের মধ্যে যা তারা কল্পনা করেছেন তা ছিল গুপ্তবিদ্যার চর্চা। প্রকৃত অতীন্দ্রিয় কিছু ঘটেনি। ভারতে গুপ্তবিদ্যা পদ্ধতিগুলি কল্পনাকে কোনও কিছু সৃষ্টি করতে খুব শক্তিশালীভাবে ব্যবহার করে। অনেক মানুষ অন্যের ক্ষতি করার জন্য গুপ্তবিদ্যাকে ব্যবহার করছেন কিন্তু গুপ্তবিদ্যা অনেক ভাল জিনিসও করতে পারে।
স্বপ্ন শুধুমাত্র আপনার মনেরই অন্য একটি মাত্রা। একমাত্র যখন সেটাকে অতিক্রম করে যান তখন আপনি এমন একটি মাত্রাকে স্পর্শ করেন যা বর্তমানে অতীন্দ্রিয়বাদ বলে পরিচিত হচ্ছে। অতীন্দ্রিয়বাদের অর্থ হল এমন কিছু, যাকে আপনি আপনার ভৌত শরীর অথবা মন দিয়ে ছুঁতে পারবেন না। আপনার মন তা করতে সক্ষম নয়। আপনার শরীর তা করতে সক্ষম নয়। সেই জগৎকে স্পর্শ করতে হলে আপনার মধ্যে অন্য একটি মাত্রা জাগ্রত হতে হবে। এটাকে এভাবে ব্যখ্যা করাই ভাল। তা না হলে, মানুষের প্রত্যেকটি স্বপ্ন এবং কল্পনা বিলাসিতাই অতীন্দ্রিয়বাদ হয়ে উঠবে।
(নিজের) ভিতরে এক মিথ্যা জগৎ
স্বপ্ন হল এক ধরণের যন্ত্র, কিন্তু খুবই পিচ্ছিল যন্ত্র। ব্যবহার করার জন্য আরও উন্নত যন্ত্র আছে কিন্তু মানুষের নিজের ভিতরটা আরও সুসংগঠিত হলে তবেই তা ব্যবহার করতে সক্ষম হবেন। যেমন ধরুন, আমি এমনভাবে তৈরি হয়েছি যে, যদি আমি চোখ বন্ধ করি, আমার কাছে গোটা জগৎটা অদৃশ্য হয়ে যায়। মানুষ বলেন, ‘তা কী করে সম্ভব?’ আচ্ছা, সেটাই তো চোখের পাতার কাজ। সেই জন্যই তো এটা আপনাকে দেওয়া হয়েছে। এটা বন্ধ করলেই সবকিছু বন্ধ হওয়া উচিত। আপনার বাড়িতে একটা জানলা আছে। আপনি যদি এটা বন্ধ করে দেন, বিশাল সূর্যটিও আটকে যায়। একটা জানলা যখন এটা করতে পারে, চোখের পাতা পারবে না কেন?
এটা তা করছে না, কারণ আপনি নিজের মধ্যে একটা মিথ্যা জগৎ তৈরি করেছেন। আপনি চোখ বন্ধ করলে বাইরের জগৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু আপনার নিজের একটি মিথ্যা জগৎ আছে, সেটা চলতেই থাকে। যদি আপনার নিজের কোনও মিথ্যা জগৎ না থাকে, আপনি যদি এই জগতেই থাকেন, চোখ বন্ধ করলেই - ফু্ঃ - চলে গেছে। যদি আমি পাঁচ’ছ দিন এক জায়গায় বসে থাকি, একটা চিন্তাও আমার থাকে না, স্বপ্নের কথা তো ভুলেই যান। একটা চিন্তাও না আসার কারণ, আমার মাথাটা পুরোপুরি খালি। সেই জন্যই এটা হালকা। খুবই হালকা, সত্যি।
https://www.youtube.com/watch?v=R4o1M6-29xI&t