তিন প্রকারের যোগী
সদগুরু বৃহত্তর ক্ষেত্রে তিন শ্রেণীর যোগীর কথা বলছেন – মন্দ, মধ্যম এবং উত্তম।
সদগুরু: কিছু কিছু যোগ ধারায় যোগীদের তিন শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়। তাদের বলা হয় – মন্দ, মধ্যম ও উত্তম।
মন্দ যোগী – বিচ্ছিন্ন চৈতন্য
মন্দ অর্থাৎ যিনি চৈতন্যের স্বাদ পেয়েছেন। যিনি সৃষ্টির উৎস আস্বাদন করেছেন। তিনি জানেন এক এবং অদ্বিতীয় কী। কিন্তু তিনি এই বোধ সারাদিন ধরে রাখতে পারেন না। এই বোধ তাঁর বারংবার স্মরণ করার প্রয়োজন পড়ে। তিনি যখন এ বিষয়ে সজাগ তখন তিনি সেখানে অবস্থান করেন। যখন তিনি এ বিষয়ে সজাগ নন তখন তিনি সমগ্র অভিজ্ঞতা হারিয়ে ফেলেন। এখানে বিষয়টা শান্তিময় অথবা সুখকর হওয়া নয়। এটা এক সংজ্ঞাহীন উৎফুল্লতার পর্যায়ে। সুতরাং এই পর্যায়ের যোগীগণ এটা জানেন কিন্তু তাঁদের এটা স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, কখনও বা তাঁরা নিজেরাই স্মরণ করেন। বা আর এক ভাবে বলতে গেলে, তাঁর উপলব্ধি সবসময় এক অবস্থায় থাকে না।
যখন আপনি সচেতন থেকে অনুভব করেন, তখন ক্ষুদ্র বিষয় থেকে বৃহৎ বিষয় সব কিছুরই অনুভূতি তার মধ্যে আসে। আর যদি আপনি যথেষ্ট সচেতন না হন, যখন আপনার অনুভব ক্ষীয়মান, তখন সকল অনুভূতি থাকে না। যখন আপনার উপলব্ধি সত্যিই ক্ষীয়মান, ধরুন আপনি যখন ঘুমে অচেতন, তখন আপনার এই জগতের বোধ ও থাকে না। এটি আপনার অভিজ্ঞতা থেকে উধাও হয়ে গেছে। আবার, একই ভাবে অপর একটি দিক আরও সূক্ষ্ম হয়ে উঠলে এবং তখন আপনার উপলব্ধির অধিক উচ্চতর মাত্রা বা আরও সচেতন স্তরের প্রয়োজন হয়। প্রচেষ্টা করে কেউই চব্বিশ ঘণ্টাই সচেতন থাকতে পারেন না। যদি আপনি সচেষ্টভাবে সচেতন থাকার প্রচেষ্টা করেন, যদি আপনি তা কিছু সেকেন্ড বা মিনিটের জন্যে হলেও পারেন, সেটা একটা বিরাট ব্যাপার। আর তা না হলে এটা অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। তাই যোগীদের এই প্রথম পর্যায়কে বলা হয় – মন্দ। মন্দ মানে এই নয় যে নির্বোধ বা নিস্তেজ, যেটা কিনা সচরাচর সাধারণ মানু্ষ ব্যবহার করে থাকে; মন্দ হল উপলব্ধির নিস্তেজতা।
মধ্যম যোগী: নিম করোলি বাবা
যোগীদের দ্বিতীয় স্তর বা দ্বিতীয় পর্যায়কে বলা হয় - মধ্যম। অর্থাৎ মধ্যমান। তার জন্য, অন্তরের মাত্রা এবং তার অতিরিক্ত যা রয়েছে, সেগুলো সর্বদাই তার উপলব্ধিতে রয়েছে, কিন্তু তিনি তার নিজের শারীরিক মাত্রাটিকে পরিচালনা করতে অক্ষম। এমন অনেক যোগী আছেন যারা আজও পূজিত হন, কিন্তু তাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের কোন কিছুতেই সক্ষম নন। তাঁরা তাঁদের জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সব ভুলে যান, এমনকি তাঁদের নাওয়া খাওয়া থেকে প্রতিদিনের প্রাতকৃত্যের কথাও মনে করিয়ে দিতে হয়। তাঁরা তখন নিজেদের মধ্যে এক তূরীয় মার্গে অবস্থান করছেন, এবং তাঁরা একটু একটু করে অসহায় শিশুর মতো হয়ে চলেন, এবং বহিরজগত থেকে তাঁরা তখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন নিম করোলি বাবা। তাঁকে যে নিয়মিত প্রাতকৃত্য করতে হবে সে বোধটুকুও তাঁর ছিল না। তিনি সারাক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকতেন। কোনও একজনকে বলতে হত, “আপনি অনেকক্ষণ এক জায়গায় বসে রয়েছেন, এবার আপনাকে উঠতে হবে!” তখন তিনি উঠবেন। তাঁর অনুভবে দৈহিক ক্রিয়াকর্ম, জাগতিক সক্রিয়তা পুরোপুরি উধাও। তাঁরা তখন এক তূরীয় অবস্থায়, কিন্তু যতই তূরীয় অবস্থায় থাকুন না কেন, আপনি তো সেই অবস্থায় থাকতে পারবেন না, কারণ যখনই আপনি এই জাগতিক সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তখন আপনি আর শারীরিক দেহে থাকতে পারবেন না।
উত্তম যোগী: গুরু দত্তাত্রেয়র কথা
এই তৃতীয় স্তরের যোগীগণ প্রতিনিয়ত চূড়ান্ত উপলব্ধির স্তরে থাকেন, একই সঙ্গে তিনি বহির্জগতের সঙ্গেও তারে বাঁধা। অনেক ক্ষেত্রেই আপনি বুঝতে পারবেন না তিনি সত্যিই যোগী না আর কেউ? এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন দত্তাত্রেয়। তাঁর আশপাশে থাকা মানুষজন বলতেন তিনি একই দেহে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের পুনঃ-অবতার। তাঁর বিষয়ে মানুষের প্রকাশ এই রকমই। কারণ তাঁরা দেখেন তাঁর সবটাই মানব স্বভাবের মতোই আবার কোন কিছুই সাধারণ মানুষের মতো নয়। তার মানে এই নয় যে তিনি অমানবিক, আবার এটাও নিশ্চিত তিনি ঠিক মানব নন। আর তাই যখন তাঁরা ওঁর মধ্যে এই সদ লক্ষণগুলো দেখেন তখনই তাঁরা তাঁকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু- মহেশ্বরের সঙ্গে তুলনা করেন। তাঁরা বলেন উনি হলেন এই তিনের মিলিত পুনর্বতার। সেই কারণেই কখনও কখনও আপনি গুরু দত্তাত্রেয়র চিত্রপট দেখে থাকবেন যেখানে তাঁকে ত্রিমূর্তি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে কারণ তিনি ওই তিনের মিলিত পুনর্বতার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
আপনারা দেখে থাকবেন দত্তাত্রেয় ফটোতে উনার তিনটি মাথা থাকতে দেখা গেছে, এর কারণ হলো উনাকে তিনজনের অবতার হিসেবে মানা হয়।
গুরু দত্তাত্রেয় বেশ হেঁয়ালিপূর্ণ জীবন যাপন করতেন। এমনকি আজও, বেশ কয়েক শত প্রজন্মের পরেও দত্তাত্রেয়র উপাসকরা বেশ শক্তিশালী বংশ। আপনারা নিশ্চয় কানফটদের কথা শুনেছেন? এমনকি আজও তাঁরা কালো কুকুর নিয়ে ঘোরেন। গুরু দত্তাত্রেয় সব সময় কালো কুকুর সঙ্গে নিয়ে ঘুরতেন, যারা ছিল নিখুঁত কালো। আপনার বাড়িতে যদি কুকুর থাকে তবে আপনি নিশ্চয় জানেন তারা আপনার চেয়ে একটু বেশিই অনুভূতিপ্রবণ। ঘ্রাণে, শ্রবণে এবং দৃষ্টিশক্তিতেও সে আপনার চেয়ে একটু বেশিই শক্তিশালী। সুতরাং, দত্তাত্রেয় অন্য ভাবনায় কুকুর সঙ্গে রাখতেন, এবং তিনি সেইসব কুকুরই বাছতেন যারা পুরোপুরি কুচকুচে কালো। এমনকি আজও কানফটদের সঙ্গে সেই জাতীয় বিশালাকার কুকুর থাকে। তাঁরা তাঁদের কুকুরদের হাঁটিয়ে নিয়ে যান না, বরং তাদের নিজেদের স্কন্ধে নিয়ে তাঁরা হাঁটেন কারণ তারা যে দত্তাত্রেয়র পোষ্য। সেই জন্যেই তাদের সঙ্গে বিশেষ আচরণ করা হয়। তিনি যে ব্যবস্থা করে গিয়েছেন তা আজও সম্পূর্ণরূপে বহাল এবং এরা সর্ববৃহৎ আধ্যাত্ম সন্ধানী বংশের মধ্যে একটি।
পরশুরামের গুরু অন্বেষণ
মহাভারতের কালে পরশুরাম ছিলেন এক মহান যোদ্ধা ঋষি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগ না দিয়েও পরশুরাম নানা ভাবে যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি শুরুতেই কর্ণের অধ্যায়টি স্থির করেছিলেন। সুতরাং তাঁর ক্ষমতা ছিল অপরিসীম, কিন্তু তাঁর মানসিক অস্থিরতা জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তাঁকে ঐশ্বরিক উপলব্ধিতে স্থির থাকতে দেয়নি। অধিকাংশ সময়েই তিনি বিরূপ ও খারাপ আবহাওয়ায় থাকতেন।
সেইজন্যেই তিনি নানান গুরু ও আচার্যের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু যখনই তিনি দেখতেন তিনি যা চাইছেন তা পুরোপুরি তাঁরা দিতে পারছেন না তখনই তিনি তাঁদের গভীরভাবে আঘাত করতেন। অবশেষে তিনি গুরু দত্তাত্রেয়র কাছে গেলেন। সবাই তাঁকে জানালেন, “দত্তাত্রেয়ই আপনার উত্তর” তিনি গেলেন তাঁর লৌহ কুঠার সঙ্গে নিয়ে। তিনি যখন চলেছেন দত্তাত্রেয়র আবাস স্থলে, বহু আধ্যাত্মিক উপাসকও সেখানে উপস্থিত হলেন। তাঁরা পৌঁছেই তাঁর আশ্রমের দিকে তাকিয়ে ছুটে পালাতে থাকলেন।
পরশুরাম যখন দত্তাত্রেয়র গৃহে উপস্থিত হলেন, দেখলেন একজন মানুষ যার এক কোলে এক মদিরার পাত্র ও অন্য কোলে এক যুবতী নারী। তিনি শুধু দেখলেন। দত্তাত্রেয়কে দেখে মনে হোলো তিনি তখন পূর্ণ মদ্যপ। পরশুরাম তাঁর দিকে তাকালেন, শেষবারের জন্যে কুঠার নামিয়ে রাখলেন ভূমিতে, এবং নিজেকে অবনত করলেন। সকলে ইতিপূর্বেই সে স্থান পরিত্যাগ করেছে। যে মুহূর্তে তিনি অবনত হলেন সেই মুহূর্তে মদিরা পূর্ণ পাত্র ও যুবতী নারী উধাও এবং দেখা গেল দত্তাত্রেয় একা বসে আছেন আর তাঁর পায়ের তলায় বসে আছে তাঁর সারমেয়। পরশুরাম তাঁর উদ্ধার খুঁজে পেলেন দত্তাত্রেয়র মধ্যে।
দত্তাত্রেয় দেখালেন তিনি এ জগতে যা কিছুই করুন না কেন তা সত্ত্বেও তিনি হারিয়ে যাবেন না এবং এটাই পরশুরামকে দেখানোর ছিল, কারণ তিনি অপরিসীম ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ কিন্তু তাঁর সেই ক্ষমতার প্রকাশ ক্রোধের মধ্য দিয়ে, সবসময় তার প্রকাশ নেতির মধ্যে এবং মানসিক অস্থিরতায়। তাই দত্তাত্রেয় তাঁকে এক বিশেষ পথে চালিত করলেন এবং পরশুরাম যখন দেখলেন এই মদিরা ও যুবতী নারী ও মদ মত্ততার পরেও দত্তাত্রেয় ঐশ্বরিক ক্ষমতার সংস্পর্শে রয়েছেন সেই মুহূর্তেই তাঁর জ্ঞানোদয় হোলো। এই উপলব্ধি যদি তাঁর জীবন জুড়েই থাকত তাহলে তাঁর মনুষ্য জীবনে কুঠার এড়ানো যেত।