তরুনরা কেন মদ ও ড্রাগের দিকে ঝুঁকছে ?
চিত্রনাট্য রচয়িতা ও পরিচালক নাগ অশ্বিনের প্রশ্ন ছিল তরুন সম্প্রদায়ের মধ্যে মদ্যপান ও ড্রাগের প্রতি আসক্তি বেড়ে যাওয়া নিয়ে। এহেন বিপথগামীতার বহুবিধ কারণ ব্যাখ্যা করে, তীব্র নেশার ফাঁদ থেকে কিশোর ও তরুণদের বার করে এনে জীবনের ভিন্নতর সুখের স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় কী হতে পারে, তার বিশ্লেষণ করলেন সদগুরু -
নাগ অশ্বিন: আমি আমাদের প্রজন্ম বা পরবর্তী প্রজন্মের ছোটদের মধ্যে মদ্যপান ও নেশার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণটা জানতে চাই। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ মদ্যপানের নেশায় আসক্ত, ইদানিং ছোটরা, বিশেষ করে স্কুলের বাচ্চারাও ড্রাগের নেশায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সাময়িক মুক্তির স্বাদ বা স্বর্গসুখের আশায়, যা অত্যন্ত ভয়ংকর ও বিপজ্জনক। আমি জানতে চাই যে, বাচ্চারা কেন এত নেশাগ্রস্ত হয়ে উঠছে এবং মানুষকে এর ফাঁদ থেকে বার করে আনার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী প্রাকৃতিক উপায় কী ?
সদগুরু: নমস্কারম নাগ! তোমার নামটা বেশ ভাল লেগেছে। এই নাগ বা কোবরা আমার খুব প্রিয়। এবং তুমি এটা জানো কি না জানিনা যে, সাপের বিষ একটি নির্দিষ্ট উপায়ে ব্যবহার করেও নেশা করা যায়।আজকের সমাজে এই নেশা করার প্রবণতা বাড়ার পিছনে বহু কারণ আছে। অন্যতম মৌলিক কারণ হল, বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে আজ আর লড়াই করতে হয় না। সমাজের একটা বড় অংশ আজ রুটি রুজির লড়াইয়ের বাইরেও ভাবতে পারছে। এই বেঁচে থাকার লড়াই যখন গৌণ হয়ে যায়, তখনই বিভিন্ন কাজে মানুষের উৎসাহ আর আগ্রহ বাড়তে থাকে। সেটা যদি ঠিকমতো না হয়, তখনই শারীরিক সুখ আর নেশার প্রয়োজন স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়তে থাকে সেই সামাজিক পরিবেশে। এই কারণেই এটা অত্যন্ত জরুরী যে, বাবা-মা যতই স্বচ্ছল হোক না কেন, একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে শিশুদের সেই স্বচ্ছলতার কথা জানাতে নেই।
এই সংস্কৃতিতে, এমনকি রাজারাও তাদের সন্তানদের গুরুকূলে পাঠাতেন যেখানে তারা অন্য শিশুদের সঙ্গে শিক্ষা পেত আর ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু নিয়ে বেড়ে উঠতো। শৃংখলা, দায়িত্বজ্ঞান আর জীবনের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার বোধ কোনও মানুষের জীবনে অর্থ সম্পদের আগেই আসা প্রয়োজন। তা না হলে ধন দৌলত বোঝা হয়ে মাথার ওপর চেপে বসবে। এটাই ঘটছে আজকের প্রজন্মের ক্ষেত্রে।
পরিশ্রম ও মনোযোগের অভাব
আরও একটা কারণ হল, অধিকাংশ বাবা-মা’ই এখন বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকেন। কম বয়সী শিশুদের যে সার্বিক মনোযোগ পাওয়ার কথা, তারা সেটা পাচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবেই নানা বিচ্যূতি আসছে জীবনে। আর শারীরিক পরিশ্রমও ওরা করে না। নিজের শারীরিক সক্ষমতাকে যদি উপভোগ করতে না পারো বা উৎফুল্লতা আর চনমনে শক্তি যদি আনন্দ না দেয়, তাহলে নেশা করাটাই তখন একমাত্র উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ড্রাগ এখন শুধু নেশার বস্তুই নয়, এটা তাদের কয়েক ঘন্টার জন্য রোমাঞ্চকর অনুভূতিও দেয়। তাই লাগামছাড়া হয়ে এই প্রজন্ম ছুটে যাচ্ছে ওদিকেই।
আরও একটা বড় কারণ যার জন্য এই প্রজন্ম ড্রাগের পিছনে ছুটছে, তা হল, স্বর্গের যে স্বপ্ন এতদিন দেখানো হয়েছে, আজ তা ক্রমশ চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এটা হয়তো ওরা সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারছে না। এটাকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করার স্বচ্ছ দৃষ্টি আর সাহসের অভাব রয়েছে ওদের। কিন্তু বহুকাল ধরে মানুষকে এভাবেই ম্যানেজ করা হয়েছে যে, “এসবের থেকে এখানে যদি দূরে থাকো, স্বর্গে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে ভোগ সুখের উপকরণ পাবে”। এখন স্বর্গই তো ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে, তাই ওরা এখানেই সেই সুরাপানের মজা নিতে চাইছে। এর পিছনে এরকম বহুবিধ কারণ আছে। তবে মৌলিক কারণ হল, ব্যক্তি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য শারীরিক সংগ্রামের প্রয়োজন আজ ফুরিয়ে গেছে। এটাই নেশার প্রয়োজনকে আজ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
অন্যতর সুখের খোঁজে
এর সমাধান কী ? এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, তোমাদের মধ্যে যাদের উঠতি বয়সের সন্তান রয়েছে, তাদের খেলাধূলায় সামিল করো এবং এমন কাজে তাদের উৎসাহ দাও যা কিনা প্রকৃতির কাছাকাছি, যেমন ট্রেকিং, পাহাড়ে চড়া বা সাঁতার কাঁটা ইত্যাদি। শিল্পকলা বা সঙ্গীত এরকম যে কোনও বিষয়ে তাদের ডুবে থাকতে হবে। এমন আনন্দের খোঁজ দিতে হবে তাদের যা কিনা বুদ্ধি বা আবেগ বা মানবিক চেতনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।
যখন মানুষ তার মনের আনন্দের খোঁজ পায়, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতার সুখ অনুভব করে, আবেগের সুখ পায়, চেতনার আনন্দ অনুভব করে, তখন শরীরের সুখে ডুবে যাওয়ার ইচ্ছা নাটকীয় ভাবে কমে যায়। তাই এটা অত্যন্ত জরুরী যে, শিশুরা যেন সবসময় নানা রকম কাজকর্মে জড়িয়ে থাকে, বিভিন্ন বিষয়ে ভালবেসে একাত্ম হয়ে থাকে, তাহলেই অ্যালকোহল আর ড্রাগের প্রয়োজন কমে যাবে।
কিন্তু আমাদের এটাও বুঝতে হবে যে, ইদানিং নেশারও প্রচন্ড হারে মার্কেটিং চলছে। সিনেমার জগত এটাকে উৎসাহ দিচ্ছে, এবং আজ সব জায়গায় মদ্যপান যেন সামাজিক বিষয় হয়ে গেছে, মদ না খেলে তোমার গুরুত্ব নেই! সকলেই প্রশ্ন করে, “সদগুরু, আপনি ড্রিঙ্ক করেন”? আমি বলি – “করি, তবে শুধু জল”। ওরা এমন ভাবে দেখে যেন আমি এক বিচিত্র প্রাণী। “শুধুই জল”? হ্যাঁ, তোমার পান করার জন্য সবচেয়ে সুন্দর পানীয় হল জল, কারণ এই শরীরের ৭০ শতাংশ উপাদান হল জল, অ্যালকোহল নয়।
ভিতর থেকেই নেশাগ্রস্ত হওয়া
এই মানবিক দেহযন্ত্রটি হল সর্ব বৃহৎ কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। যদি তুমি নেশা করতে চাও, তোমার ভিতরেই সেটা তৈরি করতে পারো - এ এমন এক নেশা যা তোমাকে নেশাগ্রস্ত করেও কিন্তু সম্পূর্ণ সচেতন রাখবে একই সঙ্গে। আমাদের শিশু ও তরুণদের এমন নেশাতেই অভ্যস্ত করতে হবে। এই কারণেই আমরা যোগের শিক্ষা প্রতিটি মানুষের জীবনে নিয়ে আসতে চাইছি। যদি তুমি নিজের ভিতরে একটি বিশেষ মাত্রায় পৌঁছাতে পারো, তাহলে এমন এক নেশায় তুমি বুঁদ হয়ে থাকবে যে কোনও ড্রাগ বা সুরা তা দিতে পারবে না। একই সঙ্গে সম্পূর্ণ সচেতনও থাকবে তুমি, এবং তোমার শরীর ও মন খুশিতে ভরপুর হয়ে থাকবে।
সময় এসে গেছে এই উন্নত প্রযুক্তিকে নিজের জীবনে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার। আমাদের কাছে এমন পদ্ধতি রয়েছে যা মানুষকে অন্তর্মুখী করে জীবনের সর্বোচ্চ সুখের অনুভুতি দেবে। আমাদের তরুণ সম্প্রদায়কে এই উপলব্ধি করাতেই হবে। তাদের যদি এই বিকল্পের সন্ধান না দাও, ওই বোতল আর ওষুধের পিছনেই ওরা ছুটবে।
বাস্তব হল, এখন স্বাস্থ্যের জন্য, শান্তির জন্য, আনন্দের জন্য তোমার কেমিক্যালের সাহায্য প্রয়োজন বা নিজের ভিতরের যে কোনও অনুভূতির জন্য তোমার কেমিক্যাল প্রয়োজন। যখন কোনও প্রজন্ম এই অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করে - ৯০ শতাংশ মানুষ যখন প্রতিদিন ওষুধ ও অন্যান্য কেমিক্যালের ভরসায় বেঁচে থাকে - তখন নিশ্চিতভাবেই পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তি আজকের চেয়ে আরও নিম্নমুখী হবে।
এটা মানব জাতির প্রতি অপরাধ। এই বাস্তব পরিস্থিতিতে আমাদের সকলকে সচেতন হয়ে সঠিক কাজটা শুরু করতে হবে।
সম্পাদকের কথা: যে প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ, যদি এমন কোনও বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকে অথবা যদি কোনও আপাত কঠিন প্রশ্ন নিজেকে ক্রমাগত বিব্রত করতে থাকে, সেক্ষেত্রে জীবনের সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সদগুরুকে আপনার প্রশ্ন করুন UnplugWithSadhguru.org.