মহাভারত পর্ব ৪: শকুন্তলার কথা ও ভরতের জন্ম
গত পর্বে আমরা চন্দ্রবংশী পূর্বপুরুষদের কাহিনী জেনেছি- পুরু পর্যন্ত। এই পুরুর থেকেই এসেছেন পাণ্ডব ও কৌরবেরা এবং তাঁর সৎ-ভাই যদু'র থেকে এসেছেন যাদবেরা। আজকের কাহিনীতে সদগুরু আমাদের শকুন্তলা-দুষ্মন্তের জনপ্রিয় গল্প এবং ভরতের জন্মের কথা বলছেন।
మన దేశానికి భారతదేశం అనే పేరు ఎలా వచ్చింది..?
শকুন্তলার জন্ম
সদগুরু: পুরুর থেকে কয়েক প্রজন্ম পরে বিশ্বামিত্র নামে একজন রাজা ছিলেন, যিনি কৌশিক নামেও পরিচিত ছিলেন। মুনি-ঋষিরা যেরকম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন- তা দেখে তাঁর মনে হয়েছিল সেই তুলনায় একজন রাজার ক্ষমতা নিতান্তই সামান্য। তাই জন্মসূত্রে রাজা হওয়া সত্ত্বেও তিনি ঋষি হতে চেয়েছিলেন। তিনি অরণ্যে গিয়ে কঠোর তপস্যা করতে শুরু করলেন।যেরকম তীব্রতার সঙ্গে তিনি এপথে এগিয়ে চলছিলেন তা দেখে ইন্দ্রের মনে হল, বিশ্বামিত্র যা চাইছেন- তা যদি তিনি অর্জন করে ফেলেন, তাহলে তাঁর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা মুশকিল হয়ে উঠবে। তখন তিনি তাঁর অন্যতম একজন "মধুচক্রের প্রতিনিধি" অপ্সরা মেনকাকে পাঠালেন। মেনকার কাজ ছিল বিশ্বামিত্রকে প্রলুব্ধ করা এবং তাঁর কঠোর সংযম ও সাধনার পথ থেকে তাঁকে বিক্ষিপ্ত করা। তিনি সফল হলেন এবং একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হলো।
কিছুসময় পর বিশ্বামিত্র বুঝতে পারলেন যে তাঁর সাধনার মাধ্যমে তিনি যা কিছু অর্জন করেছিলেন, সেসবই তিনি এই চিত্ত বিক্ষেপের কারণে হারিয়েছেন। প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হয়ে মা ও শিশুকে পরিত্যাগ করে তিনি চলে গেলেন। অপ্সরা হওয়াতে মেনকার এই জগতে উপস্থিতি ছিল শুধুমাত্র একজন স্বল্পমেয়াদী পর্যটক হিসেবে! তিনি ফিরে যেতে চাইলেন। যেহেতু তিনি মেয়েটিকে তার পিতার কাছে রেখে যেতে পারছিলেন না, কারণ তিনি সেটা চান না - তখন মেনকা মেয়েটিকে মালিনী নদীর তীরে ফেলে রেখে চলে যান।
কয়েকটি শকুন পাখি এই ছোট্ট মেয়েটিকে দেখতে পায়, কোনোভাবে মেয়েটিকে তাদের ভালো লেগে যায় এবং অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারদের থেকে তাকে তারা রক্ষা করে। একদিন কণ্ব মুনি ওই পথ দিয়ে আসছিলেন এবং তিনি এই অদ্ভুত ঘটনাটি দেখতে পান - যেখানে একটি ছোট্ট শিশুকে পাখিরা রক্ষা করছে। তিনি শিশুটিকে তুলে নেন, তাকে আশ্রমে নিয়ে যান এবং বড় করে তোলেন। যেহেতু শকুন পাখিরা তাকে রক্ষা করেছিল, তিনি তাকে শকুন্তলা নামে ডাকেন। সে বড় হয়ে এক অপরূপা যুবতী হয়ে ওঠে।
একদিন রাজা দুষ্মন্ত এক অভিযানে বের হন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে তিনি তাঁর সৈন্যদের ভোজন করাতে চাইলেন। তিনি জঙ্গলে গেলেন এবং নির্বিচারে যথাসম্ভব পশু হত্যা করতে লাগলেন তাঁর সেনাবাহিনীকে খাওয়ানোর জন্য। যখন তিনি একটি খুব বড়ো পুরুষ হরিণকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়লেন - তাঁর তীর লক্ষ্যভেদ করল, কিন্তু তা সত্ত্বেও পুংহরিণটি দৌড়ে পালিয়ে যায়। দুষ্মন্ত হরিণটিকে অনুসরণ করতে লাগলেন এবং সেটিকে শকুন্তলার হাতে দেখতে পেলেন। এটা ছিল তাঁর পোষা হরিণ এবং অত্যন্ত দরদ দিয়ে তিনি এটির শুশ্রূষা করছিলেন। এই দৃশ্য দেখে তিনি শকুন্তলার প্রেমে পড়ে যান এবং কিছু দিনের জন্য তিনি সেখানে থেকে যান। কণ্বের অনুমতি নিয়ে তিনি শকুন্তলাকে সেখানেই বিবাহ করেন।
এবার দুষ্মন্তকে ফিরে যেতে হবে। তাঁর গোটা সৈন্যবাহিনী বনপ্রান্তে অপেক্ষা করছিল। তিনি শকুন্তলাকে বললেন যে তিনি তাঁর রাজ্যে ফিরে গিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে পরে আবার ফিরে আসবেন। বিবাহের স্বীকৃতি এবং স্মারক হিসেবে তিনি তাঁর সরকারী আংটিটি খুলে শকুন্তলার আঙুলে পরিয়ে দিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এটা তার ঠিকমতো মাপে হল না। "তোমার জন্য আমি ফিরে আসবো"- এই বলে তিনি চলে গেলেন।
শকুন্তলা সবসময় একটা স্বপ্নের ঘোরে থাকতেন - এই অরণ্য-বালিকা হঠাৎ করেই হয়ে গেছেন রানী, একজন সম্রাজ্ঞী! একদিন দুর্বাসা মুনি কণ্বের আশ্রমে এলেন। তিনি খুব রাগী মানুষ ছিলেন। তিনি শকুন্তলাকে সম্বোধন করলেন কিন্তু শকুন্তলা সাড়া দিলেন না - তাঁর চোখ খোলা ছিল কিন্তু তিনি কিছুই দেখছিলেন না। তিনি অপমানিত বোধ করলেন এবং বললেন, "এই মুহূর্তে যে তোমার মন জুড়ে রয়েছে, সে যেন চিরকালের জন্য তোমায় ভুলে যায়।" সহসা তার ঘোর কেটে গেল এবং তিনি কেঁদে উঠলেন, "এ হতে পারে না! আপনি কেন এমন করলেন?"
আশ্রমের লোকজন দুর্বাসাকে বুঝিয়ে বলেন যে শকুন্তলার সঙ্গে রাজার বিবাহ হয়েছে, আর তাই তিনি অপেক্ষা করে আছেন যে রাজা ফিরে এসে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। তাঁরা বললেন, "উনি দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন - দয়া করে ওঁকে ক্ষমা করে দিন।" ইতিমধ্যেই তারা দুর্বাসার আদর- আপ্যায়ন করেছিলেন এবং তিনিও খানিকটা শান্ত হয়েছিলেন। তিনি বললেন, "ঠিক আছে, আমি এটা সংশোধন করে দিচ্ছি। সে তোমায় ভুলে গেছে ঠিকই, কিন্তু যে মুহূর্তে তুমি তাকে এমন কিছু একটা দেখাবে - যেটা তাকে তোমার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে, তখনই তার মনে পড়ে যাবে।"
ভরতের জন্ম
শকুন্তলা অপেক্ষা করতেই থাকলেন কিন্তু দুষ্মন্ত ফিরে এলেন না। তিনি একটি সন্তানের জন্ম দিলেন যাকে তিনি ভরত বলে ডাকতেন। তাঁরই নাম আজ এ দেশ বহন করছে। এই সম্রাটের নানাবিধ গুণের কারণে তাঁর নামেই এদেশের নাম ভারত বা ভারতবর্ষ রাখা হয়েছিল। তিনি একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন।
ভরত অরণ্যে বেড়ে উঠছিলেন। একদিন কণ্ব শকুন্তলাকে বললেন, "রাজা দুষ্মন্তের কাছে গিয়ে তোমার তাঁকে স্মরণ করানো উচিত যে তুমি তাঁর স্ত্রী এবং তোমাদের একটি পুত্রসন্তান আছে। এটা ঠিক নয় যে একজন রাজার ছেলে তার পিতার সান্নিধ্য ছাড়াই বেড়ে উঠছে।" শকুন্তলা তাঁর কিশোর বালকটিকে সঙ্গে নিয়ে প্রাসাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। তাঁদের একটি নদী পেরোতে হয়েছিল। তিনি তখনও প্রেমের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। তাঁরা যখন নৌকা করে একটি নদী পেরোচ্ছিলেন, নদীর জল স্পর্শ করার জন্য তিনি নিজের হাত বের করে রেখেছিলেন, আর কখন তাঁর বড় মাপের আংটিটি খুলে নদীতে পড়ে যায়। তিনি সেটা বুঝতেও পারেন নি।
তিনি রাজা ও রাজপ্রাসাদের ধরণ-ধারণ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। রাজদরবারে দুষ্মন্ত যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, "তুমি কে?" তিনি বললেন, "সেকি, আপনার মনে নেই? আমি আপনার স্ত্রী শকুন্তলা। এই হল আপনার পুত্র।" দুষ্মন্ত ভীষণ রেগে উঠলেন, "তোমার এতবড়ো স্পর্ধা! তুমি এসব কথা বলো কী করে?" সেখান থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি বুঝতে পারলেন না কী ঘটেছে! "উনি আমায় এত ভালবাসতেন! আর এখন ওনার স্মৃতি থেকে সব মুছে গেছে?"
বিফল মনোরথ হয়ে তিনি ফিরে গেলেন। এই প্রথমবার তিনি সমাজের সামনে এলেন আর দেখুন কী অবস্থা! তিনি আশ্রমের পিছনের দিকে আরও গভীর অরণ্যে চলে গেলেন এবং ছেলেকে নিয়ে জনহীন বনপ্রান্তরে বাস করতে লাগলেন। ভরত বন্য পশুদের সাথে বেড়ে উঠতে লাগলো - প্রচন্ড সাহসী, ভীষণ শক্তিশালী; যে মাটিতে তার বাস একেবারে তারই এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে।
পরবর্তীকালে, দুষ্মন্ত পুনরায় তাঁর আংটিটি খুঁজে পাওয়ার পর সেই অরণ্যে মৃগয়া করতে আসেন। তিনি দেখলেন একটি অল্পবয়সী ছেলে পূর্ণবয়স্ক সিংহদের সাথে খেলা করছে, হাতির পিঠে চড়ছে। তিনি তাঁর দিকে দেখলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, "কে তুমি? তুমি কি কোনো অতিমানব? তুমি কি কোনো দেবতা? তুমি কি অন্য কোথাও থেকে এসেছো?" ছেলেটি বললো, "না, আমি ভরত, দুষ্মন্তের পুত্র।" রাজা বলেন, "আমি দুষ্মন্ত। এ কেমন করে হয় যে আমি তোমায় চিনি না?" তখন কণ্ব এসে পুরো গল্পটি তাঁকে খুলে বললেন। অবশেষে দুষ্মন্ত, শকুন্তলা ও ভরতকে প্রাসাদে নিয়ে গেলেন।
চলবে...
Editor’s Note: A version of this article was originally published in Isha Forest Flower June 2015. Download as PDF on a “name your price, no minimum” basis or subscribe to the print version.