প্রশ্ন: সদগুরু, আপনি বলেছেন যে, খাদ্য আমাদের মনস্তাত্বিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে কীভাবে ফল আহার মনস্তাত্বিক সুস্থতা বাড়িয়ে দেয়। এসবের কী কোনও তাৎপর্য আছে? আর, মূলত ফল খেয়ে থাকা কি সেই সব মানুষের জন্য ঠিক হবে যারা সাধারণ ভাবে কাজের মধ্যে, পরিবারের মধ্যে অথবা প্রচুর শারীরিক পরিশ্রমের মধ্যে থাকেন?

সদগুরু: যে কোনও মেশিনে, যে ধরণের জ্বালানীই আমরা ব্যবহার করি না কেন, জ্বালানীর কার্যকারিতা মূলত নির্ভর করে কত সহজে এটা জ্বলতে পারে, তার উপর। যেমন ধরুন, দৈন্যন্দিন যানবাহনের জন্য যে ধরণের জ্বালানী আপনি ব্যবহার করেন তা ‘রেস কার’ বা এরোপ্লেনে ব্যবহৃত জ্বালানীর থেকে আলাদা। তার কারণ, কত সহজে এটা জ্বলে। আপনি হয়তো গ্যাস স্টেশনে ‘অকটেন লেভেল’ দেখে থাকবেন – সাতাশি, ঊন-নব্বই, নব্বই, একানব্বই, তিরানব্বই, ছিয়ানব্বই। যখন আমরা মোটরসাইকেল চালাতাম, আমরা তিনগুণ বেশি দামে একশো অকটেন কিনতাম, কারণ তৎক্ষণাৎ মোটরসাইকেল এমনভাবে কাজ করে যা অন্যগুলো পারবে না।

ফল খেলে তা সহজে হজম হয়

একই ভাবে, সবচেয়ে সহজে পরিপাকযোগ্য খাদ্য হল, ফল। পরিপাক মানে হ'ল জঠরাগ্নি - পরিপাকের আগুন। যদি এই আগুনকে সবচেয়ে ভালভাবে জ্বলতে হয়, অবশ্যই ফল হল সবচেয়ে ভাল জিনিষ। দুর্ভাগ্যবশত, অনেক মানুষ আলস্য এবং জড়তাকে উপভোগ করেন। জীবন তাদের স্পর্শ করেনি, তাই তারা তাদের একটি অংশকে মৃত হিসেবেই উপভোগ করেন। জীবন্ত, সক্রিয় ও প্রাণবন্ত হয়ে থাকার চেয়ে ঘুম, নেশা, অতিরিক্ত খাওয়া আর শুধু শুয়ে থাকাতেই বেশি আরাম অনুভব করেন। ফল শুধু এইসব মানুষের জন্য সমস্যা হতে পারে, কারণ এটা আপনাকে সতর্ক ও জাগ্রত করে রাখে। এটা আপনাকে নেশাগ্রস্ত করে রাখে না, অবশ্যই যদি না এটা গেঁজে ওঠে। এবং এক উচ্চতর পর্যায়ের জাগরণ থেকেও একজন জানতে পারেন এক চরম আনন্দের অনুভূতি, নেশার ঘোর আর গভীর তৃপ্তি। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, আমি কি ফল খেয়েও স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে পারি?

ফল আহার হল প্রকৃতির ইচ্ছা

আপনার জীবনের সাধারণ অভ্যাসের মধ্যেই এর একটা সহজ উত্তর আছে। মনে করুন আপনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বিছানায়, কেউ আপনাকে চিকেন বিরিয়ানি এনে দেবে না। তারা ফল নিয়ে আসবে, কারণ আপনার বন্ধু এবং আত্মীয়রা বোঝেন, ‘এইসব খেয়েই আপনি অসুস্থ হয়েছেন। এখন অন্তত বিচক্ষণ হয়ে খাওয়া দাওয়া করুন’। আপনি তো জানেন, এমনকি আদমও একটি ফল দিয়েই শুরু করেছিল। ফল হল একটি দিক, যেখানে প্রকৃতি নিজেই খাদ্য হতে চায়। বীজটিই হল আমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শাঁস হ'ল শুধুমাত্র একটা আকর্ষণ, একটা প্রলোভন যাতে করে জন্তু এবং পাখিরা এটা খেতে আসে আর বীজটা দূরে কোথাও বয়ে নিয়ে যায়।

ঋতু অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ফল হয়। এটা বিষ্ময়কর যে, একটা বিশেষ সময়ে মাটি যে ধরণের ফল উৎপন্ন করে, সেগুলোই শরীরের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। এটা নিয়ে অনেক পর্যবেক্ষণ হয়েছে - কীভাবে ঐসব ঋতুতে অর্থাৎ ঠান্ডার সময়, গরমের সময়, বেশি আর্দ্রতার সময় পৃথিবী থেকে সঠিক ধরনের ফল উৎপন্ন হয় - যদি আপনি সেই অঞ্চল থেকেই খাবার খান। কিন্তু আজকাল আপনি নিউজিল্যান্ড থেকে আনা ফল খাচ্ছেন। এটা অন্য ব্যাপার। আপনি যদি আপনার চারপাশের জমি থেকে উৎপন্ন খাবার খান, আপনি দেখবেন যে সঠিক ঋতুতে সঠিক ধরনের ফলই আপনার কাছে আসছে। ওই সময় খাওয়ার জন্য এটাই সবচেয়ে ভাল জিনিস।

ফল আহার করার সতর্কতা

ফল শরীরে অবিশ্বাস্য রকম কাজ করতে পারে। আপনার জীবন শৈলী যেমনই হোক, আপনি অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু যদি আপনি কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করেন - যেমন ধরুন, প্রত্যেকদিন বাইরে মাটি খুঁড়ছেন, মেশিন দিয়ে নয়, হাত দিয়ে এবং কঠোর পরিশ্রম করছেন – তাহলে প্রতি দু’ঘন্টায় আপনার ক্ষুধার্ত মনে হতে পারে। আপনি এতটাই পরিমাণ ফল খেতে পারেন কিন্তু এটা এত দ্রুত হজম হয়ে যায় যে আপনার পাকস্থলী খালি মনে হতে পারে।

আপনি আপনার মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে চান না শারীরিক পরিশ্রমের কাজে যুক্ত থাকতে চান - ফল একদম ঠিক ঠাক ভাবে কাজ করবে।

যদি আপনি পুরোপুরি ফল আহার করে থাকতে চান, আপনাকে হয়তো খাওয়ার জন্য একটু বেশি সময় দিতে হবে এবং ধীরে ধীরে খেতে হবে, যাতে করে আপনি যথেষ্ট পরিমাণে ফল খেতে পারেন। সামান্য পরিমাণ ফল খাওয়ার পরই আপনার পেট ভর্তি মনে হতে পারে - কারণ এটা সাধারণত মিষ্টি হয়, তাই আপনাকে অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে খেতে হবে। আমাদের ভিতরে একটা Bio-Clock বা জৈব ঘড়িও আছে। ধরুন স্বাভাবিক রান্না করা খাবার খেতে আপনার দশ থেকে বারো মিনিট লাগছিল। এখন যদি আপনি ফলও খান, যখনই আপনার দশ- বারো মিনিট হয়ে যাবে - আপনার শরীর বলবে যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে। সুতরাং আপনাকে সচেতন ভাবে আরও বেশি খেতে হবে, কারণ শরীর কেবল সময় দেখাচ্ছে, কতটা পেট ভরেছে তা দেখছে না।

যদি আপনি শুধু ফল খেয়ে থাকেন এবং শারীরিক ভাবে প্রচন্ড সক্রিয় হন, আপনাকে হয়তো দিনে তিনবার খাবার খেতে হবে। যদি আপনি ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমান - বাকি ষোলো থেকে আঠারো ঘণ্টার জন্য তিনবার খাওয়াই যঠেষ্ট বেশি, যদি ফল খেয়ে থাকেন। কিন্তু আপনার পেট দু’ঘণ্টার মধ্যে খালি মনে হবে, সুতরাং আপনাকে উচ্চ প্রাণশক্তি অথচ খালি পেট - এই অবস্থার সাথে অভ্যস্ত হতে হবে। এরকম অবস্থাতেই আপনার মস্তিষ্ক সবচেয়ে ভালো কাজ করে এবং আপনি, একজন মানুষ হিসেবে সবচেয়ে ভাল ভাবে কাজ করে থাকেন।

 

আপনি আপনার মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে চান কিনা শারীরিক পরিশ্রমে ব্যস্ত থাকতে চান - ফল একদম সঠিক ভাবে কাজ করবে। কিন্তু আপনি জানেন না বাজারের ফলে আজকাল কি ভরা থাকছে। সেটাই একটা সমস্যা। আমি স্পস্ট ভাবে লক্ষ্য করেছি - আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রামে যে ধরণের ফল খেতাম তা বর্তমানে আমাদের কাছে ফার্ম থেকে আসা ফলের সঙ্গে এক নয়। এগুলো অনেক বড়, আরও গোলাকার এবং দেখতে আরও সুন্দর কিন্তু এটা বোটক্সের মত।

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি এর মধ্যে সেই মাত্রায় শক্তি বা প্রাণ নেই। এইসব ফল বাজারের জন্য তৈরি, মানুষের জন্য নয়। তার মানে এই নয় যে এগুলো পুরোপুরি নষ্ট, কিন্তু এর মধ্যে সেই পরিমাণ পুষ্টি গুণ নেই যা আগে থাকত। সুতরাং আমাদের এর সাথে কিছু অন্য খাবার যোগ করে খাবারের পুষ্টিগুণ বাড়াতে হবে।

ফল আহার এই পৃথিবীর জন্যও ভাল

সর্বোপরি, ফল খাওয়া পরিবেশগত ভাবেও অত্যন্ত বিচক্ষণ খাদ্যাভ্যাস। প্রত্যেকের অন্তত তিরিশ শতাংশ ফল আহারী হওয়া উচিত - তার মানে আপনার খাবারের অন্তত তিরিশ শতাংশ হবে ফল। চাষ জমি ও শস্য থেকে না এসে, যদি আপনার খাবারের তিরিশ শতাংশ গাছ থেকে আসে - পরিবেশগত ভাবেও এটা পৃথিবীতে একটা বড় পার্থক্য গড়ে দেবে।

যদি আপনি ভারী মাংস খাওয়া থেকে ফল খাওয়াতে পরিবর্তন করতে চেষ্টা করেন, তাহলে হয়তো দেখবেন, আপনার মনে হচ্ছে, যেন কিছুই খাওয়া হয় নি, কারণ বেশি ভারী খাবার খেয়ে আপনি মাটির দিকে টান অনুভব করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এমনিতেই আপনি মৃত্যুর পর মাটিতেই মিশে যাবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে, এটাকেই আমরা জীবন বলি, যখন আমরা অতর্কিতে উঠে দাঁড়াই এমনভাবে যেন মাটির সঙ্গে আমাদের কোনও যোগ নেই। এমনকি পাখি, যেটা ওপরে উড়ে বেড়ায় - তাও মাটির থেকেই তৈরি। কিন্তু যখন এটা উঁচুতে উড়ে বেড়ায়, এটাকে মাটি বলে মনে হয় না। প্রত্যেকটি জীবন, যখন জন্মলাভ করে বা বিকশিত হয় – তখন সেটাকে মাটি বলে মনে হওয়া উচিত নয়, যদিও আমরা মাটি থেকেই তৈরি।

যদি আমরা বিকশিত হতে চাই, যে জ্বালানী আমরা ব্যবহার করব অবশ্যই এরকম হতে হবে, যেটা দ্রুত জ্বলতে পারে এবং সহজ দাহ্য। সেটাই হল সবচেয়ে ভাল খাবার। আমাদের পাকস্থলীতে নিঃসন্দেহে ফলই সবচেয়ে দ্রুত হজম হয়। তার মানে এটার নূন্যতম অবশিষ্ট পড়ে থাকে এবং শরীরে সবচেয়ে কম পরিমাণ বোঝা চাপায় বা চাপ দেয়।