যৌনতার অতিরিক্ত চিন্তা কি স্বাভাবিক ?
কামজ ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকা কতটা স্বাভাবিক, কেন অধিকাংশ মানুষ শুধু যৌনতার মধ্যেই সুখের খোঁজ করেন, তার বিশ্লেষণ করলেন সদগুরু -
প্রশ্ন: আমি আমার বেশীরভাগ সময় এবং শক্তিকে যৌনতা ও কামজ ভাবনার মধ্যেই ব্যয় করি। আমি জানিনা আমি অদ্ভুত কিনা, কিন্তু আমি মনে করি অধিকাংশ মানুষই এরকম ভাবনা নিয়ে থাকে। তবুও বলি আমার বাবা-মা এবং অভিভাবকেরা সবসময় এটাকে নিষিদ্ধ বলেই মনে করেছেন। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী তা জানতে চাই।
সদগুরু: আমাকে একটা মজার কথা বলতে দাও। একটা ছ’বছরের মেয়ে স্কুল থেকে আসার পর তার মাকে জিজ্ঞেস করল, “মা আমি কেমন করে জন্মালাম?” মা বিব্রত হয়ে পড়ল। সে বলল, “একটি সারস তোমাকে নামিয়ে দিয়েছিল”। মেয়েটি সেটা নোট করে নিল।তারপর সে প্রশ্ন করল, “মা, তুমি কেমন করে জন্মেছিলে”?
“আমাকেও একটি সারস নামিয়ে দিয়েছিল”।
“মা, ঠাকুমার জন্ম কেমন করে হয়েছিল”?
“তাকেও একটি সারস নামিয়ে দিয়েছিল”।
মেয়েটি চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে স্কুল থেকে দেওয়া বাড়ির কাজের খাতায় কিছু লিখছিল। মা অস্বস্তি অনুভব করছিলেন এবং মেয়েটি তার হোমওয়ার্ক শেষ করার পরে, মা তার খাতাটি দেখলেন। রচনাটি পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে ছিল। মেয়েটি লিখেছিল, “তিনটি প্রজন্ম ধরে আমাদের পরিবারে কেউ সাধারণভাবে জন্মায়নি”।
যৌনতা স্বাভাবিক, কামজ ভাবনা নিজের তৈরি
সুতরাং এটা কোনো অদ্ভুত ব্যপার নয়। এটা শুধু এই যে, তোমার বুদ্ধিবৃত্তি হরমোন দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এটা আসলে অদ্যম আচরণ। যখন তুমি শিশু ছিলে, কার কী জননাঙ্গ রয়েছে তা নিয়ে তোমার কোনও উৎসাহ ছিল না। হরমোন যে সময় থেকে তোমার শরীরে কাজ করতে শুরু করল, তুমি পৃথিবীকে তার বাইরে ভাবতেই পার না। তোমার যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তি হরমোন দ্বারা অপহৃত হয়েছে।
যৌনতা একটা স্বাভাবিক ঘটনা - এটা শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত, এটা শরীরের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু কামতাড়না হল সম্পূর্ণ তোমার তৈরি। এটা মানসিক বিষয়। এটা নানাভাবে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে, এটা অসুখের পর্যায়ে চলে গেছে কারণ, যৌনতা যতক্ষণ শরীরে থাকে ততক্ষণ ঠিক আছে – এটা স্বাভাবিক নিয়মেই প্রাকৃতিক পথ খুঁজে নেবে। কিন্তু যে মুহূর্তে এটা তোমার মনের মাঝে প্রবেশ করে, তখনই বিকৃতির জন্ম হয়। এর সঙ্গে মনের কোনও সম্পর্ক নেই।
যদিও যৌনতার ভাবনা মানুষের মনে বড় আকার ধারণ করেছে, এটা প্রকৃতপক্ষে অকিঞ্চিকর। যদি তুমি শরীরের সীমানাকে কিছুটা অতিক্রম করতে পারো, তাহলেই দেখবে নারী ও পুরুষেরকোনও ভেদ নেই। শুধুমাত্র শরীরের মধ্যে আটকে থাকলে একজন নারী এবং অন্যজন পুরুষ বলে পরিচিত হয়। প্রজননের মাধ্যমে প্রজাতিকে সুনিশ্চিত করার জন্যই সামান্য দৈহিক পার্থক্য রয়েছে। এই দৈহিক পার্থক্যের কারণেই সামান্য মানসিক ফারাক হয়। কিন্তু বাকি সবকিছুই এক - দুটো চোখ, নাক, মুখ - শুধু প্রজনন অঙ্গদুটি আলাদা।
কেন আমরা শরীরের এই সামান্য অংশকে মনে এত গুরুত্ব দেবো ? যদি শরীরের কোনও অংশকে এত গুরুত্ব দিতেই হয়, তবে সেটা মস্তিষ্ককে দেওয়া উচিত, প্রজনন অঙ্গকে নয়।
যৌনতার অর্থহীন দর্শন
যৌনতার ভাবনা আমাদের কাছে এত বড় কারণ, আমরা আমাদের শরীরী তন্ত্রকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের শরীরের অন্য অংশকে সহজ ভাবে গ্রহণ করলেও যৌনাঙ্গকে পারিনি। তোমার যৌনাঙ্গ তোমার হাত, পা বা অন্য অংশের মতো। কিন্তু তোমরা এটাকে “বিশেষ কিছু” ভেবে বসে আছো। এই ভাবনাটা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে মানুষের মনে এটা খুব বড় আকার নিয়েছে।
এটা তোমাদের মনে ঢুকেছে কারণ কেউ তোমাদের বলেছে এটা ভুল। এখন তুমি এটা ছাড়তে পারো না কারণ এটা “ভুল জিনিষ”। একটু খেয়াল করে দেখো, তুমি যেগুলোকে ভুল জিনিষ বলে জানো সেগুলোকে তুমি ছাড়তে পারো না, সব জায়গায় এরা পিছু নেয়।
আমরা এই অতি সাধারণ এবং মৌলিক ব্যপার নিয়ে ঠিক বা ভুলের ধারণা তৈরি করেছি। এর পর আবার দর্শন তৈরি করে সেই ভুলকে ধ্বংস করতে চেয়েছো কিন্তু তার পরেও সেটা রয়ে গেছে। মানুষের যৌনতাকে সমর্থনের জন্য কত রকমের দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আমি বুঝতে পারি না, যৌনতার জন্য দর্শনের কেন প্রয়োজন হয়। এটা শুধুই শরীর কেন্দ্রিক। যে কোনও রকমের জটিলতা এখানে অপ্রয়োজনীয়। এটাকে যত জটিল করবে, ততই এটা তোমার জীবনে অনাবশ্যক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
অর্থহীন কিছু ধারণার জন্যই আমরা কোনও কিছুকে অতিরঞ্জিত করি বা খাটো করে ফেলি। আধুনিক সমাজের দিকে তাকাও, আমার মতে প্রায় নব্বই শতাংশ মানব শক্তি ব্যয়িত হচ্ছে যৌনতার সন্ধান করতে বা সেটাকে এড়িয়ে যেতে। যৌনতার একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে তোমার জীবনে। এটাকে যদি অযথা বড় করে দেখো, তোমার মনের মধ্যে বিকৃতির জন্ম হবে। আবার এটাকে যদি মুছে ফেলতে চাও, সেক্ষেত্রে আরও বেশি মানসিক বিকৃতি তৈরি হবে।
তোমরা শরীরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছো বলেই যৌনতাকে এত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। শরীরের সাথে যত কম একাত্ম হবে, যৌন তাড়নাও তত কমতে থাকবে। তোমরা নিশ্চয় দেখেছো, যখন কেউ বুদ্ধিবৃত্তিকে সম্বল করে কর্মক্ষম হয়ে ওঠে, তখন যৌনতার ভাবনাও কমে যায় ? কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তীক্ষ্ণ মেধার উচ্চতাকে এবং মনের মাধুর্য্যকে স্পর্শ করতে পারে না; তারা আবেগের লাবণ্য; সম্পর্কে জানে না এবং শক্তির মাধুর্য্যকে উপল্বদ্ধি করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কেবলমাত্র কামজ ভাবনাই তাদের ভিন্ন উচ্চতার অনুভূতি দেয়। শরীরের একটা ছোট্ট মাধু্র্য্য যে যৌনতা, সেটাই তাদের প্রাত্যহিক জীবনের গতানুগতিকতা থেকে মুক্তি দেয়।
যৌনতা থেকে অধিক উত্তেজনা
যদি তুমি সজাগ হও এবং নিজেকে অথবা তোমার চারপাশে থাকা মানুষজনকে খুঁটিয়ে দেখো, তাহলে দেখতে পাবে যে, যারা শরীরের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তী নয়, তারা ধীরে ধীরে বেপরোয়াভাবে খুশী হতে চাইছে। যত বেশি তুমি আনন্দময় হয়ে উঠবেউঠবে, তোমার জীবনে আমোদ-প্রমোদের প্রয়োজন তত কমে যাবে। যদি তুমি আনন্দে থাকতে না জানো, তখনই বেপরোয়া কাজকর্ম প্রাধান্য পায় এবং যৌনতা তার মধ্যে একটি। মূলগত ভাবে যা আমাদের অস্তিত্বের কারণ, আমি তার বিরুদ্ধে নই, কিন্তু তোমাদের মাথা থেকে এই ভাবনাটা মুছে ফেলতেই হবে।
আমি অবাক হয়ে যাই, বহু মানুষ বলে যে, তারা “যে কাজই করুক না কেন, যৌনতা হল সর্বশ্রেষ্ঠ”। এটা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নয়। এটা অতীব জনপ্রিয় ঠিকই, কিন্তু সবচেয়ে ভাল নয়। যদি তুমি জীবনের অন্য মাত্রাগুলিকে স্পর্শ করতে সক্ষম হও, সেই ক্ষেত্রে অনুভব করবে, শিশু বয়সে যেভাবে তুমি বহু বিষয়ে উৎসাহী ছিলে অথচ বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোনও চেষ্টা ছাড়াই সেগুলো যেমন ছেড়ে দিয়েছিলে, যৌনতাকেও ঠিক সেভাবেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।
তোমার শক্তি যত বেশি স্থিত ও সূক্ষ্ম হয়ে উঠবে, অপর একটি শরীরের সঙ্গে কিছু করার প্রয়োজন তত কমে আসবে, কারণ সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র বসে থেকেই তুমি যৌনতার চেয়ে অনেক বেশি উদ্দীপনা অনুভব করতে পারবে। এই উদ্দীপনা যত বেশি তোমার জীবনের প্রত্যক্ষ অনুভূতিতে আসবে, যৌনতাও তত দ্রুত উধাও হয়ে যাবে জীবন থেকে; কারণটা এই নয় যে তুমি অক্ষম বা এটি ভুল বা অনৈতিক কাজ, আরও একটি শরীরের সঙ্গে সামান্য কিছু করাটাকে তখন তোমার প্রত্যক্ষ অনুভূতিতেই অত্যন্ত শিশুসুলভ বলে মনে হবে।
যৌনতাকে নিয়ে সমস্যা কিছু নেই, যৌনতার ক্ষেত্রে ভুল বা ঠিক বলে কিছু হয় না, এটা জীবনের একটা প্রাথমিক বিষয়মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। যদি এটা শরীরের মধ্যে থাকে, তাহলে ঠিক আছে, কিন্তু এর ভাবনা যদি মাথায় ঘোরে, তাহলে এটি ভুল জায়গায় অবস্থান করছে। এটা যদি ভুল জায়গায় অবস্থান করে, তাহলে তোমার জীবন বিশৃঙ্খল হয়ে যাবে।
সম্পাদকের কথা: যে প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ, যদি এমন কোনও বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকে অথবা যদি কোনও আপাত কঠিন প্রশ্ন নিজেকে ক্রমাগত বিব্রত করতে থাকে, সেক্ষেত্রে জীবনের সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সদগুরুকে আপনার প্রশ্ন করুন UnplugWithSadhguru.org.