কেন আজকের তরুণ প্রজন্ম যোগবিজ্ঞানের বিরোধী ?
বিজ্ঞানের শাখায় পাঠরত জনৈক কলেজ ছাত্রের প্রশ্ন ছিল, কেন আজকের তরুণ প্রজন্ম যোগবিজ্ঞানের বিরোধী ? উত্তরে, যোগবিজ্ঞানের সঠিক সংজ্ঞা ও তার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করলেন সদগুরু –
প্রশ্ন: নমস্কার, সদগুরু! আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। কিন্তু যখন যোগের কথা বলি বা শম্ভাবী ক্রিয়া করি, সকলেই কেমন যেন অবজ্ঞার চোখে দেখে, তাদের কথা হল, “তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও এসব কথা কী করে বলো” ?
একটা খারাপ লাগার অনুভূতি থেকেই প্রথম বর্ষে পড়ার সময় আমি সব সাধনা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমার প্রশ্ন হল, কেন আজকের তরুণ প্রজন্ম যোগবিজ্ঞানের এত বিরোধী ? এই গভীর বিজ্ঞানকে তাদের কাছে গ্রহণীয় করে তোলাটা কি জরুরী নয় ? শুরুতেই অশ্রদ্ধা না করে যাতে তারা এই বিজ্ঞানটির প্রতি অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এই পরিবর্তন কী ভাবে আনা সম্ভব ?
সদগুরু: দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাই অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে গেছে। যে কোনও বিষয়ের নিয়মানুগ পদ্ধতিগত অনুসন্ধানই হল বিজ্ঞানের মৌলিক ভিত্তি। বিজ্ঞান বলতে আমরা পদার্থবিদ্যাকেই বুঝি। কিন্তু জীববিদ্যা, মনোবিদ্যা বা সমাজবিদ্যা বিজ্ঞানেরই ভিন্নতর কিছু শাখা। সুতরাং, যে কোনও বিষয়ে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার এই সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিকেই বলে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি – যা শুধু কোনও ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
সেই অর্থে বলতে গেলে, যোগবিজ্ঞানের মতো বিজ্ঞানের অন্য কোনও শাখাই জীবনের ক্ষেত্রে এত প্রাসঙ্গিক নয়। সমস্যা হল, যোগ বলতে ইদানিং মানুষ যা বোঝেন আসলে তা আমেরিকা দেশটির মাধ্যমে প্রতিফলিত হওয়া কিছু ধ্যানধারণা। ওদের ধারণায় নির্দিষ্ট কিছু পোশাক ও তদনুযায়ী আচরণের মধ্যে যোগ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ওদের কাছে এটা এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যোগ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল সংযুক্তিকরণ। এখন প্রশ্ন হল, এই সংযুক্তিকরণের অর্থ কী ? প্রথমেই বলি, যে শরীরটা আজ তুমি বয়ে নিয়ে চলেছো, কোনও একদিন এটাকে দাহ করা বা কবরস্থ করা হবে। যে ভাবেই হোক না কেন, তোমার এই শরীরটা কি মাটিতেই মিশে যাবে না ?
প্রশ্নকর্তা: হ্যাঁ।
Sadhguru: এখনও, আপনি কিন্তু এই পৃথিবীর অতি-ই ক্ষুদ্র একটি আবির্ভাব। এই ব্যাপারটা আপনি ভুলে গেছেন কারন আপনাকে চলাফেরা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। গাছের মতন আপনি যদি একটি স্থানেই আটকা পড়ে থাকতেন, তাহলে নিশ্চিত ভাবে আপনি এটা বুঝতেন যে আপনি এই ধরণীরই একটা টুকরো মাত্র। পৃথিবী আপনাকে সামান্য একটু চলাফেরা করার ক্ষমতা দিল, ব্যাস্ আপনি কিরকম বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে গেলেন! এটা শুধু আমাদের ভৌত–শরীরের জন্য সত্য নয়, গোটা ব্রহ্মাণ্ডর জন্য এটা সত্য, আপনার অস্তিত্বের প্রত্যেকটি অংশের জন্য এটা সত্য।
সুতরাং, যোগ বা সংযুক্তিকরণ হল সেই বিজ্ঞান, যা তোমার ব্যক্তি আমি’র সীমানাগুলি প্রতিনিয়ত মুছে দিতে থাকে, তোমাকে জীবনের বৃহত্তর সম্ভাবনায় উন্নীত করতে থাকে। এখানে তুমি অতি সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারো অথবা ব্যাপক ও প্রাণবন্ত জীবনের পরিচয় রেখে যেতে পারো। সীমাবদ্ধ জীবন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনার সমন্বয়ে তৈরি। অধিকাংশ মানুষের জীবনই খুব ছোট ছোট ঘটনার সমাহার। যদি জানতে চাও যে, তাদের জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত কোনগুলি, উত্তর পাবে, “যখন আমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম”, তারপর আসবে, “যখন আমি চাকরি পেলাম অত্যন্ত ভাললাগার অনুভূতি এল কিন্তু বাকীরা আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। তারপর বিয়ে করলাম এবং সে এক অসাধারণ অনুভূতি, কিন্তু তারপর এলেন শাশুড়ি-মা এবং ব্যস, সব শেষ”! ঠিক এভাবেই ব্যাপারটা চলতে থাকে। সকলেই জীবনের পাঁচটি অসাধারণ মুহূর্তের কথা বলেন। কিন্তু জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই যদি প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ না হয়, সেক্ষেত্রে সে জীবন হল সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ।
যদি আপনি একটা প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসময় জীবনযাপন করতে চান, তাহলে আপনার ব্যাক্তিত্বের সীমানাগুলোকে ভাঙতেই হবে, অন্তত কিছুটা তো অবশ্যই। কেবল তখনই, আপনি জীবনের একটা বৃহত্তর টুকরো পাবেন, জীবনের একটা উচ্চতর অভিজ্ঞতা অনুভব করবেন এবং আপনার মধ্যে জীবনোচ্ছ্বাসের এক গভীরতর প্রবাহ বইবে। ছোট বয়সে সাবান জলে কাঠি ডুবিয়ে বুদ্বুদ উড়িয়েছো ?
প্রশ্নকর্তা: এখন ওড়াই না, এখন তরুণ বয়সে এসে গেছি ....
সদগুরু: ওঃ! এই সাবানের বুদ্বুদ কি উড়িয়েছো তোমারশৈশবে?
প্রশ্নকর্তা: হ্যাঁ।
সদগুরু: ধরো, তোমার বুদ্বুদ যত বড় হল তার থেকে অনেক বড় বুদ্বুদ তৈরি করল আর একজন। কী করে ওটা বড় হল ? তোমারও ফুসফুস বায়ুপূর্ণ ছিল, একই সাবানের জল ছিল তোমার কাছে, কিন্তু পরেও অন্যের তৈরি বুদ্বুদটা বড় হয়ে গেল। সুতরাং, সীমানাকে প্রসারিত করার ইচ্ছাটাই শেষ কথা নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল, ওই সীমিত বুদবুদটি সর্বোচ্চ যে পরিমাণ বায়ু ধারণে সক্ষম সেই পরিমাণ বায়ু তার মধ্যে আছে কি না। যদি থাকে, বুদ্বুদটি বড় হবে।
একইভাবে, তোমার শরীর আর আমার শরীর দুটি পৃথক অস্তিত্ব। মাটিতে না মেশা পর্যন্ত আমরা বুঝতেই চাই না যে, দুটি শরীরই একই পার্থিব উপাদানে তৈরি। কিন্তু এই মুহূর্তে একশো ভাগ নিশ্চিত যে, এটা আমার শরীর আর ওটা তোমার শরীর, আমার মনটা আমার আর তোমার মনটা তোমার। এই দুটি ভৌত অস্তিত্ব কখনই এক হতে পারে না। কিন্তু আমার জীবন আর তোমার জীবন বলে আলাদা কিছু হতে পারে না। জীবন বা জীবনের অস্তিত্ব একই। সমগ্র জীবনের কতখানি তুমি সংগ্রহ করতে পেরেছো সেটিই স্থির করে দেবে তোমার ব্যক্তি জীবন কতটা সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে। কতটা তথ্য চারপাশ থেকে তুমি সংগ্রহ করেছো তা দিয়ে কিছু যায় আসে না। জীবনের সম্ভাবনা উন্মোচন করতে হলে তোমার ব্যক্তি আমি-র সীমিত পরিসরটিকে অতিক্রম করে জীবনের পরিধিটি ক্রমাগত বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে। তোমার ব্যক্তি আমি-র সীমানাগুলি সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যাবে যখন, সেই অবস্থাটিই হবে প্রকৃত যোগ। যিনি প্রত্যক্ষ উপলব্ধিতে ওই ব্যক্তিত্বের সীমানাগুলি মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন, তিনিই যোগী। কোনও মানুষ নিজেকে প্রসারিত করতে কতটা সক্ষম হবেন, তা নির্ভর করে সেই মানুষটির বাহ্যিক জীবনের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতের উপর। কিন্তু আমি কেন্দ্রিক ব্যক্তিত্বের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার জন্য একমুখী ও নির্দিষ্ট নিয়মানুগ প্রচেষ্টা তো করা যেতেই পারে।
তোমার ব্যক্তি কেন্দ্রিক আমি-বোধের সীমারেখা তো তোমারই তৈরি, তাই নয় কি? সীমানাগুলি তুমিই তৈরি করলে আবার সেই ঘেরাটোপের মধ্যে তুমিই যন্ত্রণা পাচ্ছো, এ কেমন জীবন তোমার ? যদি প্রকৃতি তোমার ব্যক্তিত্বের সীমানাগুলি তৈরি করে দিতো, আর তার ফলে যদি যন্ত্রণাবিদ্ধ হতে, সেক্ষেত্রে না হয় বোঝা যেত। কিন্তু তুমি তো নিজেকে সংরক্ষণের তাগিদেই ব্যক্তিত্বকে পাথুরে দেওয়াল তুলে মুড়ে ফেলেছো। এই আত্ম সংরক্ষণের প্রবণতাই তোমাকে একদিন আপাদমস্তক বন্দী করে ফেলবে। ওই বন্দীত্বকে ঘোচাতে চাইলে, নিজেকে প্রসারিত করতে চাইলে, যোগ-এর পথে আসতেই হবে তোমাকে। না, যোগের অর্থ শরীরকে দুমড়ে, বেঁকিয়ে বা শীর্ষাসনে থাকা নয়। নিদ্রিত হও অথবা জাগরণে থাকো – জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সমস্ত কাজের মধ্যেই তুমি যোগ-এর অনুশীলন করতে পারো। যোগ-এ থাকার অর্থ নির্দিষ্ট কিছু করা নয়, এর অর্থ হল, প্রতিটি মুহূর্তে নিজেকে জীবনের সর্বোচ্চ সম্ভাবনার স্তরে উত্তীর্ণ করার প্রচেষ্টায় ব্যপৃত থাকা।
সকলেই আমাকে প্রশ্ন করেন, “সদগুরু, আপনি কত ঘন্টা যোগাসন করে থাকেন এখন”? আমি উত্তরে বলি, “কুড়ি সেকেন্ড”! কথাটা একশো ভাগ সত্যি, আমি মাত্র কুড়ি সেকেন্ডে আমার সাধনা সম্পূর্ণ করি। সকালে ঘুম থকে ওঠার পর মাত্র কুড়ি সেকেন্ড ব্যাপী সাধনাতেই আমি সম্পূর্ণ হয়ে উঠি। তাহলে কি আমি দিনের বাকি সময়টা যোগের মধ্যে থাকি না ? উত্তর হল – আমি যোগ-এর মধ্যে বেঁচে থাকি কারণ, প্রতিটি মুহূর্তে নিজের ব্যক্তি-আমি ও সকলের আমি-বোধেরসীমানাগুলি মুছে ফেলার কাজটাই করে চলেছি সারা জীবন জুড়ে। একেই বলে যোগ। এই মুহূর্তে যা করছি, তাকেই বলে যোগ।
সম্পাদকের কথা: যে প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ, যদি এমন কোনও বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর প্রশ্ন থাকে অথবা যদি কোনও আপাত কঠিন প্রশ্ন নিজেকে ক্রমাগত বিব্রত করতে থাকে, সেক্ষেত্রে জীবনের সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। সদগুরুকে আপনার প্রশ্ন করুন UnplugWithSadhguru.org.